শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

বন্ধুত্ব ধারণা ও বাস্তবতা

দুঃখ আনন্দের মমতাপূর্ণ ভাগীদার ছাড়া জীবন এক বিরান মরুভূমি ছাড়া কিছুই নয় দার্শনিক এমারসন বলেছেন, একজন বন্ধু হচ্ছেন প্রকৃতির সবচেয়ে বড় মাস্টারপিস বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্যে কবি বা দার্শনিক হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই আপনার আনন্দ এবং দুঃখে আপনার পাশে কেউ না থাকলে আনন্দ যেমন বহুলাংশে মাটি হয়ে যায়, তেমনি দুঃখও সহজে হালকা হয় না মানুষ যখন বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তখন বন্ধুর কাছ থেকে সে প্রথম সান্ত্বনা পায়, আর যখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে তখন আনন্দের খবর সে প্রথম বন্ধুকেই জানায় বন্ধুত্বের সাথে যেহেতু আবেগের ব্যাপার জড়িত সেহেতু বন্ধুত্ব আনন্দের সাথে সাথে সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে তাই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, বন্ধুর কাছ থেকে কতটুকু চাওয়া পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির বা সমস্যার পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে বন্ধুত্ব কেমন হওয়া উচিত নিয়ে অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে ধারণাগুলো নিয়ে আমরা যদি একটু আলোচনা করি তাহলে দেখব বাস্তবতা আসলে ভিন্ন ধারণা বাস্তবতার পার্থক্য পরিষ্কার হলে বন্ধুত্ব আরও ¯^vfvweK প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে বন্ধুত্ব সম্পর্কিত কয়েকটি প্রচলিত ধারণাকে বাস্তবতার আলোকে বিচার করলেই আমাদের কাছে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে ধারণাগুলো হচ্ছে : 
. ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একে অন্যের জীবনের সবকিছুতেই ভাগীদার হবে সাধারণভাবে ধারণা প্রচলিত হলেও আধুনিক নগরজীবনে ধারণা বাস্তবসম্মত নয় অধিকাংশের কর্মজীবনের বন্ধু এবং পারিবারিক বন্ধু ভিন্ন আবার পড়শীদের সাথে যে বন্ধুত্ব তা- আলাদা শখ বা আগ্রহের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তা- আলাদা আবার ধর্মচর্চার বেলায় দেখা যায় সম্পূর্ণ আলাদা কারোর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব এক সম্পূর্ণ ¯^vfvweK ঘটনা কারণ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জীবনের সব ব্যাপারেই দুই ব্যক্তির মধ্যে আগ্রহের মিল হওয়া খুব দুর্লভ ব্যাপার এমনকি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এমন কিছু আগ্রহ শখ থাকতে পারে যেগুলোর সাথে আপনার আগ্রহের আদৌ মিল নেই তাছাড়া সদানির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব কামনা, শিশুসুলভ নিরাপত্তাহীনতাবোধেরই প্রকাশ একজন বন্ধুর উপর পুরোপুরি নির্ভরতা অনেক সময়ই দুঃখের কারণ হতে পারে অপরপক্ষ তার সামাজিক পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করলেই প্রথম পক্ষকে দুঃখবোধে পেয়ে বসতে পারে তাই একক বন্ধুত্বের চেয়ে একাধিক বন্ধুত্ব সবসময়ই আবেগগতভাবে ভাল 
. সত্যিকারের বন্ধুত্ব মানে আজীবন বন্ধুত্ব ধারণা সবসময় ঠিক নয় ছোটবেলায় যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, শিক্ষাজীবনে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তার অধিকাংশই হারিয়ে যায় আবার বাসস্থান পরিবর্তনের কারণেও পুরানো বন্ধুত্বের জায়গায় নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় কর্মজীবী মহিলাদের বেলায় ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট কর্মজীবনে বা শিক্ষাজীবনে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়, কর্ম শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গেলে তখন বন্ধুত্বের আওতা পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে তবে ধরনের খণ্ডকালীন বন্ধুত্বকেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কোন প্রয়োজন নেই জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রয়োজনীয় আনন্দদায়ক বন্ধুত্ব হতে পারে
. বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্ব সম্ভব নয় ধারণাও সবসময় সত্যি নয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিপরীত লিঙ্গের সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্বের ঘটনাও এখন প্রায়শই দেখা যায় কোন পুরুষ নারীর মধ্যে কোন আগ্রহের বা উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব হতে পারে মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ধরনের বন্ধুত্বকে কামবর্জিত রাখা কখনও কখনও বেশ কঠিন যখন আপনি কাউকে পছন্দ করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি হিসাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হন তখন তার প্রতি যৌন অনুভূতিও সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু এই অনুভূতি অনুসারে যে কাজ করতে হবে এমন কোন কথা নেই আপনি অনুভূতিকে মনে মনে ¯^xKvi করে নিয়েও তা সীমার মধ্যে রেখে দিলে সমস্যা না- আসতে পারে
. রক্ত পানির চেয়ে গাঢ় বন্ধুদের চেয়ে আত্মীয়রা ঘনিষ্ঠ ধারণাও সবসময় ঠিক নয় এমনও দেখা গেছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, বোনের সাথে বোনের চিন্তা-চেতনা কোন কিছুরই মিল নেই তাদের বাবা-মা এক- এছাড়া  তাদের মধ্যে আর কোন মিল পাওয়া যায় না এমনও দেখা যায়, একজনের বিপদে ভাই-বোনদের বদলে বন্ধুই এগিয়ে আসে কারণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পছন্দের ভিত্তিতে আর আত্মীয়রা একে অন্যের সাথে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ রক্ত পানির চেয়ে ঘন হতে পারে, কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেলে তা আঠাল হয়ে অকেজো হয়ে যায় তাই অধিকাংশ সময় দেখা যায় বন্ধুরা বন্ধুদের যেভাবে বোঝে অনুভব করে আত্মীয়রা সেভাবে বোঝেও না, অনুভবও করে না
. ভাল বন্ধুদের সমসাময়িক হতে হবে ধারণাও সবসময় ঠিক নয় ২৬ বছরের যুবকের সাথে ৫০ বছরের প্রৌঢ়ের বন্ধুত্ব হতে পারে আর বন্ধুত্ব অত্যন্ত পরিপূরক হতে পারে দুই প্রজন্মের মধ্যে বন্ধুত্ব উভয়ের জন্যে অতিরিক্ত কিছু সুযোগ এনে দিতে পারে বয়স্ক বন্ধু তরুণের জন্যে জ্ঞান, বুদ্ধি, পরামর্শের উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে আর তরুণের কাছ থেকে বয়স্ক পেতে পারে তারুণ্যের উদ্দীপনা
. বিপদে বন্ধুর পরিচয় অধিকাংশ সময়ই কথা ঠিক হতে পারে তবে কখনও কখনও ব্যতিক্রমও দেখা যায় বিপদে বা দুঃসময়ে যে বন্ধুর মত এগিয়ে আসে, অনেক সময় বিপদ কেটে গেলে বন্ধুত্বের সেই তীব্রতা থাকে না কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বলেন, দুঃসময়ের বন্ধুত্ব সুসময়েই ভেঙে যায় কারণ সুস্থ বন্ধুত্ব দেয়া-নেয়ার উপর নির্ভরশীল বন্ধুরা পালাক্রমে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সহানুভূতি দেয় এবং নেয় কিন্তু কোন কোন মানুষ সহানুভূতি দিতে চায়, নিতে চায় না আবার কেউ কেউ অচেতনভাবে কামনা করে বন্ধু যে ভাবাবেগজনিত সমস্যা বা দুঃসময়ে পড়েছে তা অব্যাহত থাকুক যাতে সে ক্রমাগত সহানুভূতি বিলিয়ে যেতে পারে তাই কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্ধু যখন খারাপ মানসিক অবস্থা থেকে ভাল অবস্থার দিকে এগুতে শুরু করে তখন ওই ত্রাণকর্তা বন্ধুটি নিজের অজ্ঞাতসারে সুপরিবর্তনকে স্যাবোটাজ করতে চেষ্টা করে লক্ষ্য একটিই- যাতে বন্ধুত্বের ধারা অপরিবর্তনীয় থাকে
. ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে ধারণাও ঠিক নয় বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বন্ধুরা অনেক দূরে থাকে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাতের কোন সুযোগ নেই, দীর্ঘদিন পরে হয়তো দেখা হয় কিন্তু দেখা হওয়ার সাথে সাথে তাদের যে অন্তরঙ্গতার প্রকাশ ঘটে তা দেখে কেউ মনে করতে পারে যে এরা সবসময় কাছাকাছি একসাথে আছে যখন উভয়ে উভয়কে অনন্য মনে করে তখন দীর্ঘ বিচ্ছেদ সত্ত্বেও বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকে
বয়স বাড়লে নতুন বন্ধু পাওয়া যায় না ধারণাও আসলে ঠিক নয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন বন্ধুত্ব সৃষ্টি হতে পারে আবার সক্রিয় কর্মজীবন সমাপ্তির পরেও চমৎকার নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হতে পারে বন্ধুত্ব সম্পর্কে ধারণা বাস্তবতাগুলো সামনে রাখলে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন