বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১২

বন্ধুত্ব ও ভালবাসা



বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাৎ আছে, কিন্তু ঝট্‌ করিয়া সে তফাৎ ধরা যায় না।
বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালোবাসার পাত্র হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমন-কি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক্‌ এই আমাদের ইচ্ছা— আর, বন্ধু আমাদেরই মত দোষে গুণে জড়িত মর্ত্যের মানুষ হইয়া থাক্‌ এই আমাদের আবশ্যক। আমাদের ডান হাতে বাম হাতে বন্ধুত্ব। আমরা বন্ধুর নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সাহায্য চাই ও সেই জন্যই বন্ধুকে চাই। কিন্তু ভালোবাসার স্থলে আমরা সর্বপ্রথমে ভালোবাসার পাত্রকেই চাই ও তাহাকে সর্বতোভাবে পাইতে চাই বলিয়াই তাহার নিকট হইতে মমতা চাই, সমবেদনা চাই, সঙ্গ চাই। কিছুই না পাই যদি, তবুও তাহাকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় তাহাকেই আমি চাই, বন্ধুত্বে তাহার কিয়দংশ চাই। বন্ধুত্ব বলি তে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ। অতএব বন্ধুত্ব অর্থে দুই এবং তিন, প্রেম অর্থে এক এবং দুই।
অনেকে বলিয়া থাকেন বন্ধুত্ব ক্রমশ পরিবর্তিত হইয়া ভালোবাসায় উপনীত হইতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা নামিয়া অবশেষে বন্ধুত্বে আসিয়া ঠেকিতে পারে না। একবার যাহাকে ভালোবাসিয়াছি , হয় তাহাকে ভালোবাসিব নয় ভালোবাসিব না; কিন্তু একবার যাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব হইয়াছে, ক্রমে তাহার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপিত হইতে আটক নাই। অর্থাৎ বন্ধুত্বের উঠিবার নামিবার স্থান আছে। কারণ, সে সমস্ত স্থান আটক করিয়া থাকে না। কিন্তু ভালোবাসার উন্নতি অবনতির স্থান নাই। যখন সে থাকে তখন সে সমস্ত স্থান জুড়িয়া থাকে, নয় সে থাকে না। যখন সে দেখে তাহার অধিকার হ্রাস হইয়া আসিতেছে তখন সে বন্ধুত্বের ক্ষুদ্র স্থানটুকু অধিকার করিয়া থাকিতে চায় না। যে রাজা ছিল সে ফকির হইতে রাজি আছে, কিন্তু করদ জায়গীরদার হইয়া থাকিবে কিরূপে? হয় রাজত্ব নয় ফকিরী, ইহার মধ্যে তাহার দাঁড়াইবার স্থান নাই। ইহা ছাড়া আর একটা কথা আছে— প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়

বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১২

দ্বিধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


এসেছিলু তবু আস নাই, তাই
জানায়ে গেলে
সমুখের পথে পলাতকা পদ-পতন ফেলে।
তোমার সে উদাসীনতা
উপহাসভরে জানালো কি মোর দীনতা।
সে কি চল-করা অবহেলা, জানি না সে-
চপল চরণ সত্য কি ঘাসে ঘাসে
গেল উপেক্ষা মেলে।
পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা ঝরে জল,
ছলছল করে শ্যাম বনাস্ততল।

তুমি কোথা দুরে কুঞ্জছায়াতে
মিলে গেলে কলমুখর মায়াতে,
পিছে পিছে তব ছায়ারৌদ্রের
খেলা গেলে তুমি খেলে।
বাহিরেতে

দ্বিধা


কোথাও কোন শব্দ নেই-
নিঃশব্দ, নৈঃশব্দ্য সূচকীয় উঠানামা আলোয়
অন্তর্গত নিঃশ্বাস শেষে;
ফিরে আসা ফের-
নীরবতার ভেতরেই অবিন্যস্ত উদভ্রান্তি
নাকের শিয়রে ঘাম জমে-
ঘন বৃত্তে শ্লথ হয় দ্বিধা
চেনা রাস্তা দিয়েই রাত্রি গড়ায়-
ক্রমশ জটিলতার দিকে…
উদ্দাম অরণ্যের মতো দ্বিধারা জাগে;
দুপুরের শব্দ চুরমার হয়
সমস্ত আলোড়নে
শারীরিক দ্বিধা-
ক্ষয়ে যায় বিগলিত হাটুসমেত;
জোছনার হাত ধরে বেড়ে ওঠে হরিণী সংশয়।
ঝাপসা চশমার ফাঁকে,
লৌকিক ব্যাখ্যায় কাতর হয় স্বপ্নগুলো

সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

আমি ভাবতে চাইনি জীবনের পুরু-ভাব!

মাঝে মাঝে কোন কারন ছাড়াই অস্থির লাগে । অনেক বুড়ো বটগাছের সাথে তুলনা করলে আমার পাতায় এখনো লাগেনি ঠিক মত সবুজের ছোপ, মায়াবী কোন বাতাসের কাঁপন, কিংবা দামাল ঢেউ । পকেটে হাত দিলে এখনো নুড়ি কুড়োনো দুপুর, ভাপের মাঝে হাত পুড়ানো সকালের নাস্তা, কিংবা মুখ কান ঢাকা ভয়ের রাতে কাঁথার অন্ধকার । সে বেলা একটুও মনে জাগেনি এই চলে যাচ্ছে আমার - জীরাফের গ্রীবার মত রাজকীয় দিন স্বপ্নপুরির রহস্যহীন কল্পলোকের মায়া ।

অন্যখানে আরো বেশি গুপ্তধন । ইচ্ছে হলেই রাশি রাশি লাল নীল বাদামি কটকটি আর হাওয়াই মিঠাই লোভে ছুট লাগানো পথের বাঁক । লুকোনো চিঠির ভালোবাসাবাসি । রাশভারি চোখে চশমা আর দুই হাত পিছে বেঁধে স্তুম্ভ, দম্ভ, গর্ব আর অহংকারি কলমীলতার সাদা আলপনা বড্ড লোভনীয় ছিলো ।

সভ্যতা কিংবা মানুষের ইতিহাস! না চাইলেও ঝুটি পাকিয়ে বেনুনী, সমতল থেকে পাহাড়ি উপত্তকার দম্ভে কিংবা মসৃন কণ্ঠের কণ্ঠার হাড়, বিরান ভূমিতে মৃদু ঝোপঝাড় আলাদা করে, জীবনের ডুমুর ফল আর ইচিংবিচিং সরল জীবনে ঢুকেযায় স্তব্ধ করতল, জঙ্ঘা, উরুর অলিখিত বালুকা বেলা ।
শুরুতে সব কিছু বড্ড ঝকঝকে শিহরনের নাজানা লুকোনো ডায়রী । টুকটাক দু’কলম লিখে লুকিয়েও কত সুখ কিছু জানা কিছু নাজানায় । সীমারেখায় এসে কুসুম কুড়োনো ভোর, কাঁকড়ের দুপুর, কিংবা আতশ ফুরিয়ে কালো কালো দানার বাজি গুলোর মতই শ্যতলা সন্ধ্যায় ঘনঘন জল বিয়োগের রোগী । চোখের খ্যচড়া চাহনী, দাতকপাটির বাঁকে বাঁকে কালো থিকথিকে পুরোনো অবহেলার ছোপ । বাতাসে ধুমসো স্বপ্নের বিরক্তিকর চুড়মাড় ।

তবুও পাকে রুগ্ন ফলগুলো অথবা পাকতেই হবে বলে জোছনা কিংবা জলের মাঝে আলুথালু কাব্য চলে । বিশুদ্ধ গন্ধের নারীর খোঁজে চন্দ্রাহত কোন মাতাল ছরছর করে জলের খেলায় মাতে লেংচে চলা কুকুরের একপা তোলা নাচের মুদ্রায়। টেরিকাটা আবেগে ধোপদুরস্ত সিংহপুরুষ খুঁজেফিরে শ্মশানের কল্কিপোড়া ফুলেল ফ্রকের ডুরেপাড় নারী । শিশুরা হারায় বালক বালিকার জীবনে । বালক বালিকার হাতে রমরমা সভ্যতার কুচক্রি মলাট ।

এতো এতো কারনের পরেও কেবল কারনহীন ভাবে অসাধারন জীবন সাধারন ধ্যনে বয়ে চলা । না মাঝি না নৌকা না মেঘ না আকাশের মাছ কিংবা পাখির স্বপ্নে

 collected

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সম্পর্ক, সম্পর্কবোধ, সম্পর্কের দায়

জীবনের অন্য নাম সম্পর্ক। কিংবা সম্পর্ক মানেই জীবন- বলা যায় এভাবেও। নানা ধরনের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবন কাটায় মানুষ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী-সহমর্মী এবং এই ধরনের আরও অনেক মানবিক সম্পর্ক প্রায় নিয়তি-নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে মানুষের জীবনে। শুধু কি তাই? সম্পর্ক স্থাপিত হয় জড় জগতের সঙ্গেও। যে প্রিয় কলমটি দিয়ে আমি লিখি তার সঙ্গেও কি একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার? নইলে ওটা ছাড়া লিখতে আমি অস্বস্তি বোধ করি কেন? খাবার টেবিলে সবসময় কেন একটি নির্দিষ্ট চেয়ারেই বসি অন্য সব চেয়ার খালি থাকলেও! এমন তো নয় যে, ওই চেয়ারটিই আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেউ! যে কাপটিতে আমি চা খাই, যে গ্লাসটিতে পানি, যে প্লেটে ভাত, ঘুমানোর সময় যে বালিশটি মাথায় দেই, যে ঘড়িটি হাতে পড়ি, যে দোকান থেকে সিগারেট কিনি _ এসবকিছুর সঙ্গেই একটি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে আমার। কিংবা এভাবে কি বলবো যে, এগুলোর সঙ্গে আমার এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে? আর সেজন্যই এর যে কোনোকিছুর অনুপস্থিতি বা ব্যতিক্রম আমার মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করে! সম্পর্কের অন্য নাম কি তবে অভ্যাস? জীবন মানে সম্পর্ক আর সম্পর্ক মানে অভ্যাস! জীবন কি তাহলে নানারকম অভ্যাসেরই প্র্যাকটিস? তা যদি হয়ও, তবু তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে।

অফিসে আমার টেবিলের কাঁচটি ভাঙা। দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙা। আমি বদলাই না। বললেই হয়ে যায়, ঐ সুসজ্জিত অফিসে ওই ভাঙা কাঁচটি বেশ বেমানান এবং দৃষ্টিকটুও বটে। তবু আমি সেটা বদলাই না কেন? বদলাই না, কারণ ঐ গর্জিয়াস প্রতিষ্ঠানে ভাঙা কাঁচটি যেমন বেমানান, ম্লান, মিসফিট- আমিও তেমনই ওখানে বেমানান, ম্লান, মিসফিট। যেন উভয়ে মিলে প্রতিষ্ঠানটির আভিজাত্যকে মুখ ব্যাদান করে উপহাস করে যাচ্ছি।

ভাঙা কাঁচটির সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাই আমি, ওটার জন্য মায়া জন্মে গেছে আমার- ওটাকে তাই বদলাতে পারি না।
একবার খুব পুরনো একটা গ্লাস ভেঙে যাওয়ায় মাকে রীতিমতো কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। ওই গ্লাসের দাম এমন কিছু বেশি ছিলো না, আর মা নিশ্চয়ই দামের কথা ভেবে কাঁদেওনি। নিশ্চয়ই ওটার সঙ্গে মায়ের অনেক স্মৃতি ছিলো। আর এই স্মৃতিই তৈরি করেছিলো সম্পর্ক।

বস্তুজগতের সঙ্গে এভাবেই হয়তো সম্পর্ক তৈরি হয় মানুষের।

২.
মানুষের অনেকগুলো সম্পর্ক নিয়তি-নির্ধারিত বা প্রকৃতি প্রদত্ত। মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্নীয়স্বজন ছাড়াও যে দেশটিতে যে সমাজে যে সময়কালে সে জন্মগ্রহণ করে, এর কোনোকিছুই সে নিজে বেছে নেয় না। প্রকৃতি তাকে এই সম্পর্কগুলো উপহার দেয়। সে এগুলো মূল্যবান মনে করুক আর না করুক, এমনকি এগুলো তার কাছে বোঝা হয়ে উঠলেও তার কিছু করার নেই, কারণ প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনোকিছুকে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করা যায় না। একজন মানুষ বড়জোর এগুলো থেকে পালিয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে পারে- এসকেপিস্টরা সেটাই করে, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিংবা কে জানে, প্রকৃতি প্রদত্ত বলে, সহজে পাওয়া গেছে বলে মানুষের কাছে এগুলোর মূল্য কম- মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এই যে, সে কিছু না কিছু অর্জন করতে চায়, অর্জনে যে আনন্দ, সহজপ্রাপ্তিতে সেই আনন্দ নেই বলেই। আর তাই মানুষ এইসব সম্পর্কেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না। সারাজীবন ধরে সে নানারকম সম্পর্ক নির্মাণ করে যায়, এমনকি ঘটনাক্রমেও সে অনেক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের উদ্ভাবিত শ্রেষ্ঠ দুটো সম্পর্কের নাম- প্রেম ও বন্ধুত্ব। অবশ্য প্রেম শব্দটি দিয়েই সব সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তা কাদের সঙ্গে প্রেম হয় অথবা বন্ধুত্ব? একজন মানুষ আরও হাজার মানুষ থাকতে কেন একজন নির্দিষ্ট মানুষের সঙ্গে এরকম সম্পর্ক গড়ে তোলে? আমার মনে হয় মানুষ আসলে তার প্রেমেই পড়ে যার মধ্যে সে নিজেকে প্রকাশিত হতে দেখে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়- সারাজীবন ধরে মানুষ অন্যের চোখে নিজেকে দেখে নিতে চায়। তার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয় এই একটি জিনিসকে কেন্দ্র করেই। একটি সুন্দর শার্ট আমি পড়ি কেন? পড়ি আমাকে সুন্দর লাগবে বলে। কিন্তু সুন্দর না লাগলে অসুবিধা কোথায়? লাগলেই বা সুবিধাটি কি? কি যায় আসে এই সুন্দর লাগা না লাগায়? যায় আসে। আমি চাই অন্যের চোখ থেকে আমার প্রশংসা ঝড়ে পড়ুক। আমি যে সুন্দর সেটা যদি জানাও থাকে আমার তা যেন যথেষ্ঠ নয়, আমি অন্যের চোখে নিজেকে দেখে নিতে চাই। অন্যের চোখ থেকে প্রশংসা ঝরে না পড়লে আমার সমস্ত সৌন্দর্যই ম্লান ও ব্যর্থ হয়ে যায়। একটি চায়ের কাপ কেনার সময় কেন সবচেয়ে সুন্দর সেটটিই কিনতে চাই আমি? কারণ যে অতিথিকে আমি সেই কাপে চা দেব, তার কাছ থেকে যেন আমি আমার রুচির প্রশংসা শুনতে পাই। মানুষ এমনই- নিজেই অজান্তেই সে নিজেকে কেন্দ্র করে ঘোরে।

প্রেমও তাই। আমি তাকেই চাই, তারই প্রেমে পড়ি যার মধ্যে আমার পছন্দের বিষয়গুলো আছে, যার চোখে তাকালে আমি নিজেকে দেখতে পাই।

৩.
প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়ে যায়- এটা খুবই প্রচলিত কথা। কেন এটা বলে সবাই? তার কারণ কি এই যে, প্রেমে পড়লে প্রেমিকটি এমন সব আচরণ করে যা তাকে মানায় না, যা তার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না! সম্ভবত তাই। কিন্তু কেনই বা সে এমন আচরণ করে? করে _ কারণ তখন সে ইনোসেন্ট হয়ে যায়। প্রেম যত গভীর তত বেশি আবেগময় এবং বেহিসেবি- আর প্রেমে পড়া মানুষটি তত বেশি ইনোসেন্ট। কোথায় যেন পড়েছিলাম _ সারাটি জীবন মানুষ যে তার শৈশবে ফিরতে চায় তার কারণ- তার ভেতরে থাকে সরলতার কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষা, থাকে ইনোসেন্ট হবার আকাঙ্ক্ষা। শৈশব মানেই তো সারল্য, নিস্পাপতা আর সহজতা। বয়স যত বাড়ে ততই বাড়ে জটিলতা, বাড়ে ভার- জীবন ক্রমশ জটিল আর ভারি হয়ে ওঠে, মানুষ পরিণত হয় ভারবাহী প্রাণীতে। জটিলতায় আক্রান্ত মানুষ তাই শৈশবে ফিরতে চায়, সেখানে সে এক অসামান্য সরলতার কাছে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু চাইলেই কি ফেরা যায় শৈশবে? যায় না। আর প্রেম সেখানেই পালন করে দারুণ কার্যকরী ভূমিকা। প্রেম মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশব- কৈশোরের সরলতায়, সহজতায়, নিস্পাপতায়।

কিন্তু এমন প্রেম কোথায় পাওয়া যায়? এখন, এই বস্তুবাদী সময়ে প্রেম মানেই হিসেব-নিকেশ, বিয়ে, সংসার, সম্পত্তি, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব হিসেব নিকেশের মধ্যে প্রেম পালাবার পথ পায় না। জীবনের অন্যান্য জটিলতার মতোই প্রেম দেখা দেয় এক ভয়ংকর জটিলতা হিসেবে। সেখানে আর আবেগ থাকেনা, থাকে না উদ্দামতা, উচ্ছ্বলতা, আনন্দ- মাথা জাগিয়ে থাকে কেবলই হিসেব নিকেশ। সমাজের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুজন মানুষ আর পাশাপাশি হাঁটবার প্রেরণা পায় না নিজের ভেতরেই।

৪.
সব সম্পর্ককেই মানুষ কোনো না কোনো নাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাস নেই তার, নেই আস্থাও, কিংবা বহুমাত্রিক সম্পর্কের বিষয়টি সে বোঝেই না। ফলে একটি নাম না দিলে সে অস্বস্তিতে ভোগে, অশান্তিতে ভোগে। কিন্তু যখনই একটি সম্পর্কের নাম দেয়া হয় তখনই তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, সেই সম্পর্কে নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্ক হয়ে পড়ে স্থির, বদ্ধ।

অথচ সম্পর্ক বিষয়টিই পরিবর্তনশীল, বিবর্তনশীল। এক জায়গার দাঁড়িয়ে থাকার জিনিস নয় এটা। সম্পর্ক ক্রমাগত তার ধরন পাল্টায়, তার স্বভাব পাল্টায়- যদি না পাল্টায় তবে তা পরিণত হয় অভ্যাসে। সম্পর্কের সঙ্গে অভ্যাসের পার্থক্যটা এখানেই। সম্পর্ক বিবর্তনশীল, পরিবর্তনকামী, নতুন মাত্রা যোগের সম্ভাবনাপূর্ণ, আর অভ্যাস স্থির, পরিবর্তনহীন, একঘেঁয়েমিপূর্ণ।

মানুষ যে সম্পর্কের একটি নাম দিতে চায় তার কারণটি হয়তো এই যে, সে সম্পর্কের একমাত্রায় বিশ্বাস করে, স্বস্তি পায়- সম্পর্কটিকে একটি মীমাংসায় পেঁৗছে দিতে চায়, একটি সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলতে চায়।

অথচ অমীমাংসিত সম্পর্কই সুন্দর, যদিও তা বেদনাদায়ক। অসংজ্ঞায়িত সম্পর্কই সম্ভাবনাপূর্ণ, যদিও তা বহন করা কষ্টকর। কিন্তু এই বেদনা, এই কষ্টও মধুর। মানুষ এমনকি মধুর কষ্টও কেন ভোগ করতে চায় না কে জানে!

৫.

এত এত সম্পর্ক আমাদের তবু কেউ কেউ কেন এমন নিঃসঙ্গ বোধ করে? কেন কারো কারো মনে হয়-

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।

তবে কি কোনো সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত আশ্রয় দেয় না মানুষকে?

কোনো কোনো মানুষ হয়তো কারো কাছে আশ্রয় খুঁজে পায়, নিজেকে অনেকখানি মেলেও ধরতে পারে, নিজের দুঃখ-বেদনা-হাহাকার-কষ্ট আর না পাওয়ার যন্ত্রণার কথা, সুখ-আনন্দ-প্রাপ্তি-উচ্ছ্বাসের কথা অবলীলায় অকুণ্ঠে বলে যেতে পারে। এরা উদার ও প্রকাশক্ষম মানুষ, সম্পর্কিত মানুষটিকে সে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে- নিজেকে মেলে ধরতে তাই দ্বিধা করে না।

কিন্তু সমস্যাটা অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়েই, স্বভাবতই যারা প্রকাশ-অক্ষম। এরা নিজেদের প্রায় সমস্ত কথাই গোপন করে রাখে, প্রায় কিছুই প্রকাশ করে না বা করতে পারে না। হয়তো কোনো একজন মানুষকে সব কথা বলে দেবার মতো বিশ্বাসযোগ্য বলেও মনে করেনা বা করতে পারে না, সম্পূর্ণভাবে আস্থাও রাখতে পারে না কারো ওপর। অন্তর্মুখী মানুষরা তাই অন্যের ভালো বন্ধু হয় বটে, কারণ তারা বলে কম, শোনে বেশি, কিন্তু নিজেরা কোনো বন্ধু খুঁজে পায় না। তাদের অধিকাংশ কথা অকথিত রয়ে যায়, প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় তারা বিপন্ন ও দগ্ধ হতে থাকে- কোনোকিছুতেই তাদের মুক্তি মেলে না। এদের মতো অসহায় মানুষ আর নেই পৃথিবীতে। সম্পর্ক ব্যাপারটা দ্বিপাক্ষিক- এরা তা বোঝে না, অথবা বুঝলেও স্বভাবের কারণেই নিজেকে মেলে ধরার ব্যাপারে কুণ্ঠিত হয়ে থাকে সবসময়। তাদের এই স্বভাব যতটা না স্বনির্মিত তারচেয়ে বেশি প্রকৃতিপ্রদত্ত- এরা তাই প্রকৃতিগতভাবেই দুঃখী-একা-বিপন্ন।
কিন্তু এই দু-ধরনের মানুষই কিছু কিছু কথা সারাজীবনের জন্য গোপন করে রাখে। কিছু কষ্ট-অপমান-যন্ত্রণা ও বেদনার কথা কাউকেই কোনোদিন বলা হয় না তার। এইরকম অনেক কথাই বুকের গোপন কোটরে জমা রেখে মানুষকে মরে যেতে হয়!

তাহলে কতদূর এগুলো মানুষ? এই এত এত বিপুল সৃষ্টি, আবিষ্কার আর সাফল্য- এত গান, এত কবিতা, এত গল্প-উপন্যাস, এত দর্শন, বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিজয়যাত্রা, মনস্তত্ত্ব নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা-তত্ত্ব-তথ্য এবং এই এত এত আরো সবকিছু অথচ মানুষ আজও এমন একটি নির্মাণ করতে শেখেনি- যা আয়নার মতো স্বচ্ছ, যার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেখে নেয়া যায়, যার কাছে নিজের সব-সব কথা বলে যাওয়া যায়, অনেক কথা না বলে না বলতে পারার বেদনা নিয়ে চলে যেতে হয় না।

আমার মনে হয়- সম্পর্কই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের জীবনে। অমন একটি সম্পর্ক যে পর্যন্ত মানুষ নির্মাণ না করতে শিখবে মানুষ, ততদিন পর্যন্ত তার মুক্তি নেই।

( সংগৃহীত)

বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

জীবন ও সাহিত্য দর্শন ( রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর )


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (বাংলা ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮) (খ্রিস্টীয় ৭ মে, ১৮৬১ – ৭ অগস্ট, ১৯৪১) ছিলেন বাংলা তথা ভারতের বিশিষ্ট কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সংগীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তিনি বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’, ‘বিশ্বকবি’ ও ‘কবিগুরু’ অভিধায় অভিহিত করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তাঁর জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তাঁর মোট ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান যথাক্রমে ‘গল্পগুচ্ছ’ ও ‘গীতবিতান’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২টি খণ্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে ‘চিঠিপত্র’ সংকলনে ও অন্য চারটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রায় দু’হাজার ছবিও এঁকেছিলেন। তাঁর রচনা আজ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে ও হচ্ছে।
ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার এক ধনাঢ্য সংস্কৃতিবান পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। বাল্যে প্রথাগত শিক্ষা গ্রহণে তিনি অসম্মত হয়েছিলেন। তাই গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মাত্র আট বছর বয়সে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন তিনি। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটির নাম ছিল ‘অভিলাষ’। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৮৮৩ সালে মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৯০ সাল থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে বসবাস শুরু করেন। ১৯০১ সালে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। এখানেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯০২ সালে তাঁর পত্নীবিয়োগ হয়। ১৯০৫ সালে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথই এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নাইট উপাধি প্রদান করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি সেই উপাধি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিকেতন। এই সংস্থা গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করে। ১৯২৩ সালে শান্তিনিকেতনেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিদ্যালয়। দীর্ঘজীবনে বহুবার বিদেশভ্রমণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রচার করেছিলেন সৌভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বমানবতার বাণী। ১৯৪১ সালে দীর্ঘ রোগভোগের পর কলকাতার পৈত্রিক বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। তাঁর গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদি ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। গ্রামীণ উন্নয়ন ও গ্রামীণ জনসমাজে শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে সার্বিক সমাজকল্যাণের তত্ত্ব প্রচার করতেন তিনি। পাশাপাশি সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ঈশ্বর এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের মূল নিহিত রয়েছে মানব সংসারের মধ্যেই। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরকে পূজার কথা বলতেন। সংগীত ও নৃত্যকে তিনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাঁর গান। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ তাঁরই রচনা।

জীবন
*
উদয়দিগঙ্গনে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর পত্নী সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার শুধু ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তাই ছিল না, বরং সেযুগের কলকাতার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সংস্কৃতিবান পরিবার হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কিন্তু এহেন পরিবারের সন্তান হয়েও পিতামাতার সান্নিধ্য থেকে দূরে ভৃত্য ও অন্যান্য আত্মীয়দের শাসনে ছেলেবেলা কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর নিজের ভাষায় সে ছিল ‘ভৃত্যরাজক-তন্ত্র’। শৈশবে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণহীন বিদ্যার আয়োজনে বিতৃষ্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত বালক রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তখন বাড়িতেই গৃহশিক্ষক রেখে তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। অতি শৈশবে একবার জোড়াসাঁকোর বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গঙ্গাতীরে পানিহাটির বাগানবাড়িতে সেই প্রথম মুক্ত প্রকৃতির সংস্পর্শে আসেন তিনি।
প্রথম দেশভ্রমণের সুযোগ অবশ্য পেয়েছিলেন ১১ বছর বয়সে। ১৮৭৩ সালে তাঁর উপনয়ন হয়। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশভ্রমণের নেশা তাঁকে বছরের অধিকাংশ সময়ই দেশান্তরী করে রাখত। উপনয়নের পর দেবেন্দ্রনাথ পুত্রকে নিয়ে দেশভ্রমণে বের হন। প্রথমে তাঁরা আসেন শান্তিনিকেতনে। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম নাটক ‘পৃথ্বীরাজ পরাজয়’ রচনা করেন। এই নাটকটির পাণ্ডুলিপি তাঁর জীব্বদশাতেই হারিয়ে যায়। শান্তিনিকেতনে কিছুকাল কাটিয়ে চলে যান পাঞ্জাবের অমৃতসরে। এখানে থাকাকালীন স্বর্ণমন্দিরে শিখদের ভজন ও উপাসনা পদ্ধতি চাক্ষুষ করেন পিতাপুত্র। এরপর আসেন ডালহৌসির নিকট বক্রোটা পাহাড়ের চূড়ায়। জায়গাটি বর্তমানে হিমাচল প্রদেশ রাজ্যে, সেই সময় অবশ্য পাঞ্জাবেরই অন্তর্গত ছিল। বক্রোটার বাংলোয় দেবেন্দ্রনাথ নিজে বালক রবীন্দ্রনাথকে কিছু কিছু পাঠ দিতে থাকেন। পিতার কাছে এই সময় রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ নিতে থাকেন। পিতার অনুপ্রেরণায় উৎসাহিত হন মহামানবদের জীবনী, কালিদাসের ধ্রুপদি সংস্কৃত কাব্য-নাটক এবং উপনিষদ্ পাঠে। ফিরে এসে গৃহশিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের কাছে পাঠগ্রহণকালে রবীন্দ্রনাথ শেকসপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ ও কালিদাসের ‘কুমারসম্ভবম্’ নাটকের কিয়দংশ অনুবাদ করেন।
১৮৭৪ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের ‘অভিলাষ’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটিই তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা। ১৮৭৫ সালে বার্ষিক হিন্দুমেলা উৎসব উপলক্ষ্যে তিনি রচনা করেন ‘হিন্দুমেলার উপহার’। কবিতাটি প্রকাশিত হয় ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য়। এই বছরই মাতৃবিয়োগ হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। এগুলি হল ‘মেঘনাদবধ কাব্যের সমালোচনা’, ভানুসিং-ভণিতাযুক্ত রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক কবিতাগুচ্ছ (যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) এবং ‘ভিখারিণী’ ও ‘করুণা’ নামে দুটি গল্প। উল্লেখ্য, ‘ভিখারিণী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটোগল্প। ১৮৭৭ সালেই দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অলীকবাবু’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয়ের মাধ্যমে রঙ্গালয়ে আবির্ভাব ঘটে নট রবীন্দ্রনাথের। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’। এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থও বটে। এই বছরই বিলেত যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সেকালের বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে অবস্থিত আমেদাবাদ শহরে যান রবীন্দ্রনাথ। সেখানে আনা তড়খড় নামে একটি মারাঠি মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই ব্যর্থ প্রণয়ের ছায়া পড়েছিল ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘নলিনী’ নাট্যকাব্যে।
যৌবননিকুঞ্জে
১৮৭৮ সালে সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গেলেন ইংল্যান্ডে। উদ্দেশ্য ছিল ব্যারিস্টার হওয়া। প্রথমে এলেন ব্রাইটনে। ভর্তি হলেন সেখানকার একটি পাবলিক স্কুলে। পরে ১৮৭৯ সালে ভর্তি হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হল আইনবিদ্যা পাঠ। কিন্তু সাহিত্যের আকর্ষণে সেই পাঠ খুব একটা এগোল না। এই সময় শেকসপিয়র ও অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকদের রচনা নিবিড়ভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেন ‘রিলিজিও মেদিচি’, ‘কোরিওলেনাস’ ও ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’। নিজের ইংল্যান্ড বাসের অভিজ্ঞতার কথা ‘ভারতী’ পত্রিকায় পত্রাকারে পাঠাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। বড়োদাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের টীকা সহকারে ‘য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা’ নামে প্রকাশিত হতে লাগল, সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত। ১৮৮১ সালে ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হল সেটি। ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ তথা চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বই। দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি ছাড়াই দেশে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে আনলেন পাশ্চাত্য সংগীতের সুর ও অপেরা নাট্যশৈলী সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ফসল ১৮৮১ সালের ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’। ১৮৮২ সালে রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যার বিবাহসভায় সদ্যপ্রকাশিত ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কবিতা শুনে নিজের গলার মালা খুলে রবীন্দ্রনাথের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) ঠাকুরবাড়ির অধস্তন কর্মচারী বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হল। বিবাহিত জীবনে ভবতারিণী হলেন মৃণালিনী দেবী (১৮৭৩–১৯০২ )।
১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথের বাল্য সহচরী তথা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। এই আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ জানা যায় না। তবে এই ঘটনা রবীন্দ্রনাথের মনে এক গভীর রেখাপাত করেছিল। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী সম্পর্কের রসায়ন তাই পরবর্তীকালের গবেষকদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৮৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৮৬ সালে জন্ম হয় জ্যেষ্ঠ সন্তান মাধুরীলতার (১৮৮৬–১৯১৮)। ১৮৮৮ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে চলে আসেন উত্তর ভারতের গাজিপুরে। ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা তিনি এখানে বসেই লিখেছিলেন। এই বছর ২৭ নভেম্বর জন্ম হয় রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৮৮–১৯৬১)। ১৮৯০-৯১ সাল নাগাদ দেবেন্দ্রনাথের আদেশক্রমে নদিয়া, কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহী অঞ্চলের জমিদারিগুলির তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময় দীর্ঘ কয়েক বছর সপরিবারে কলকাতা ও শিলাইদহে পর্যায়ক্রমে বসবাস করেন। ১৮৯১ সালে দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩), ১৮৯৪ সালে কনিষ্ঠা কন্যা মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) ও ১৮৯৬ সালে কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের (১৮৯৬–১৯০৭) জন্ম হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে রবীন্দ্রনাথের ন’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলি হল: ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’, ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কণিকা’ (১৮৯৯), ‘কথা’, ‘কাহিনী’, ‘কল্পনা’ ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০)। ১৮৯০ সালে পূর্ববঙ্গের সাজাদপুরে বসে তিনি লেখেন ‘বিসর্জন’ নাটকটি। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় নাট্যকাব্য ‘চিত্রাঙ্গদা’। সেই সঙ্গে নিয়মিত গীতিচর্চাও করতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৯৪ সালে গ্রহণ করেন ‘সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার। এই পত্রিকাতেই সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কিছু গদ্যরচনা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম ৮৪টি গল্পের অর্ধেকই এই সময়ের রচনা। এই গল্পগুলির রসদ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ হিন্দুসমাজ থেকে।
বিশ্ববীণারবে
১৯০১ সালে শিলাইদহ ছেড়ে পাকাপাকিভাবে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তিনিকেতনে চলে এলেন রবীন্দ্রনাথ। ইতিপূর্বে এখানে দেবেন্দ্রনাথ একটি আশ্রম ও ব্রহ্মমন্দির স্থাপন করেছিলেন। এই আশ্রম, ব্রহ্মমন্দির, আম্রকুঞ্জ ও একটি গ্রন্থাগার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন একটি পরীক্ষামূলক স্কুল। নাম দিলেন ‘ব্রহ্ম বিদ্যালয়’। এরই মধ্যে একের পর এক নিকটজনের মৃত্যু রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করে তুলল। ১৯০২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী চলে গেলেন। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চলে গেলেন কন্যা রেণুকা। ১৯০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কবির পিতৃবিয়োগ হল। সবচেয়ে মর্মান্তিক মৃত্যুশোক এল ১৯০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে। এই মৃত্যুশোক থেকেই উৎসারিত হল তাঁর কাব্যধারার ‘গীতাঞ্জলি’ পর্যায়টি।
এসবের মধ্যেই ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়লেন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে। যৌবনে পূর্ববঙ্গের গ্রামজীবনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রত্যক্ষ অনুভূতি তাঁকে স্বদেশের প্রকৃত উন্নতির পথটি সম্পর্কে ভাবিয়ে তুলল। রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, গ্রামীণ সমাজের সার্বিক উন্নতি ছাড়া দেশের উন্নতি অসম্ভব। ব্রহ্মবিদ্যালয়ের মাধ্যমে মুক্তশিক্ষার প্রচারের পাশাপাশি গ্রামোন্নয়নের জন্যও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন তিনি। ১৯০৬ সালে জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকে আধুনিক কৃষি ও গোপালন বিদ্যা শিক্ষা এবং ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠ জামাতা নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষার জন্য পাঠালেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের শিক্ষার খরচ বহন করলেন নিজেই। এই সময়ে শান্তিনিকেতন আশ্রমে দেখা দিল তীব্র অর্থসংকট। স্ত্রীর গয়না, পুরীর বসতবাটী, বইয়ের স্বত্ব বিক্রি করে চলতে লাগল ব্যয়নির্বাহ।
ইতিমধ্যেই বাংলায় তো বটেই, বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কবিখ্যাতি। ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬) ও ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০) কাব্যগ্রন্থের নির্বাচিত কিছু কবিতার অনুবাদ পাশ্চাত্য সমাজে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিত করে তুলল। এই অনুবাদগুলির সংকলন ‘সংস অফারিংস’ বা ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১৩) প্রকাশিত হওয়ার পর সুইডিশ আকাদেমি তাঁকে ভূষিত করল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দিয়ে। রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম এশীয় নোবেলজয়ী সাহিত্যিক। ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করল। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এই উপাধি ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ।
বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকে প্রত্যক্ষভাবে গ্রামোন্নয়নের কাজ শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২১ সালে স্থাপিত হল ‘পল্লীসংগঠন কেন্দ্র’। রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিনিকেতনের একাধিক শিক্ষক ও ছাত্র। সংস্থাটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এই সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ‘শ্রীনিকেতন’। দেশ ও বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিশেষজ্ঞেরা শ্রীনিকেতনকে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য প্রেরণ করতেন। শ্রীনিকেতন আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধের সোচ্চার হতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ। ত্রিশের দশকের প্রথম ভাগ থেকে কবিতা-গান ও বক্তৃতার মাধ্যমে বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকেন।
দিনান্তবেলায়
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দশকটি (১৯৩২-১৯৪১) তাঁর সৃষ্টিকলার ইতিহাসে এক অত্যাশ্চর্য পর্যায়। এই পর্বে তাঁর সাকুল্যে ৫০টি বই প্রকাশিত হয়। সাহিত্যের নানা ধারায় নব নব সৃষ্টিপরীক্ষায় মেতে উঠেছিলেন সপ্ততিপর রবীন্দ্রনাথ। এই পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল তাঁর গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্যগুলি। রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার গদ্যকবিতাগুলি সংকলিত হয়েছে ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘শ্যামলী’ ও ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) – এই চারটি সংকলনে। বাংলা নাট্যসাহিত্যের এক যুগান্তর তাঁর এই সময়কার নৃত্যনাট্যগুলি – ‘নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬; ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯২) কাব্যনাট্যের নৃত্যাভিনয়-উপযোগী রূপ),‘শ্যামা’ (১৯৩৯) ও ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৯)। জীবনের শেষ দশকে তিনি রচনা করে ফেলেছিলেন তিনটি ভিন্নধর্মী উপন্যাসও – ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) ও ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ‘বিশ্বপরিচয়’। এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তগুলি সরল বাংলা গদ্যে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তাঁর কাব্যেও। ‘সে’ (১৯৩৭), ‘তিন সঙ্গী’ (১৯৪০) ও ‘গল্পসল্প’ (১৯৪১) গল্পসংকলন তিনটিতে তাঁর বিজ্ঞানী চরিত্র-কেন্দ্রিক একাধিক গল্প সংকলিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর আঁকা অধিকাংশ ছবিও এই সময়েরই সৃষ্টি।
বিজ্ঞানচর্চা ও কুসংস্কারের বিরোধিতা জীবনের এই পর্যায়ে রবীন্দ্র-চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিহার প্রদেশে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে বহু লোকের মৃত্যু হয়। মহাত্মা গান্ধী এই ভূমিকম্পকে ‘ঈশ্বরের রোষ’ বলে চিহ্নিত করলে, এহেন অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি বাংলার আর্থিক দুরবস্থা ও ভারতের রাজনৈতিক সমস্যাও এই সময়ে রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ চিন্তিত করে রেখেছিল।
জীবনের শেষ চারটি বছর রবীন্দ্রনাথের কেটেছিল ধারাবাহিক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে। ১৯৩৭ সালে একবার তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবার সেরে উঠলেও, ১৯৪০ সালের অসুস্থতার পর আর সেরে ওঠেননি। অসুখ-আরোগ্য-অসুখের লুকোচুরি খেলার মধ্যে লেখা তাঁর শেষ চারটি কাব্যগ্রন্থে মৃত্যুচেতনাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়ে তোলেন কিছু অসামান্য পংক্তি। ১৯৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সাম্মানিক ডি. লিট. প্রদান করে। মৃত্যুর সাত দিন আগে পর্যন্ত কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৪১ সালে জোড়াসাঁকোর পৈত্রিক বাসভবনেই তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।
ভুবনবীণা
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২। এই সময়পর্বের মধ্যে বারোটি বিশ্বভ্রমণ কর্মসূচি। আর তারই মাধ্যমে ৫টি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ।
যৌবনে দু’বার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বার ১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলেন ১৮৯০ সালে। কেন গিয়েছিলেন, তার কারণ ঠিক স্পষ্ট নয়। ১৯১২ সালে তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গেলেন ব্যক্তিগত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। এই সময়েই ইয়েটস প্রমুখ ইংরেজ কবি ও বিদ্বজ্জনেদের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি। ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ রবীন্দ্রনাথ পাঠ করে শোনালেন এই নতুন বন্ধুমহলে। সকলে মুগ্ধ। ইয়েটস স্বয়ং লিখে দিলেন বইটির ভূমিকা। এরপর ১৯১৩ সালে এই বইটির জন্যই রবীন্দ্রনাথ পেলেন সাহিত্যে নোবেল। উল্লেখ্য, এই তৃতীয় বিলেত সফরের সময়েই দীনবন্ধু সি এফ অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল।
১৯১৬-১৭ সালে প্রথমে জাপানে ও পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কতকগুলি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতামালায় সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ উভয় দেশেই প্রত্যাখ্যাত হন রবীন্দ্রনাথ। তবে তাঁর এই বক্তৃতাগুলি সংকলিত হয়ে থাকে ‘ন্যাশনালিজম্’ (১৯১৭) সংকলনে।
১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণে যান রবীন্দ্রনাথ। এই সফরকালে পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সংবর্ধিতও হন তিনি। ১৯২৪ সালে যান চীন সফরে। সেখান থেকে আবার যান জাপানে। এবারেও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বক্তৃতা দেন জাপানে।
১৯২৪ সালের শেষ দিকে পেরু সরকারের কাছ থেকে সেদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পেরুর বদলে থেকে যান সেই দেশেই। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আতিথেয়তায় কাটান তিনটি মাস। অসুস্থতার জন্য পেরু যাওয়া বাতিল হয়ে যায়।
১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান ইতালিতে। প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ক্রমে লোকমুখে মুসোলিনির স্বৈরাচার-অত্যাচারের কথা জানতে পেরে তাঁর সমালোচনায় মুখর হলেন তিনি। ফলত, উভয়ের উষ্ণ সম্পর্কে অচিরেই পড়ল ছেদ। গ্রিস, তুরস্ক ও মিশর ঘুরে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন ভারতে।
১৯২৭ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চললেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণে। দেখলেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে শেষ বার ইংল্যান্ড গেলেন অক্সফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর গেলেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণ করলেন। ১৯৩৪ সালে গেলেন সিংহলে। এই ছিল তাঁর শেষ বিদেশ সফর।
একাধিক বইতে রবীন্দ্রনাথ লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এই বইগুলি হল: ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ (১৮৮১), ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’ (১৮৯১, ১৮৯৩), ‘জাপান-যাত্রী’ (১৯১৯), ‘যাত্রী’ (‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারি’ ও ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’, ১৯২৯), ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩১), ‘পারস্যে’ (১৯৩৬) ও ‘পথের সঞ্চয়’ (১৯৩৯)। সাক্ষাৎ করেছিলেন অরিঁ বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে। জীবনের শেষপর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় জাতিগত ভেদবুদ্ধি ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বিতৃষ্ণা তীব্রতর হয়েছিল মাত্র। আর জীবনব্যাপী বিশ্বভ্রমণের ফলে ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে আদানপ্রদানের পথটিই প্রশস্ত করেছিলেন কবি।
সাহিত্য
*
রসতীর্থ-পথের পথিক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। মাত্র আট বছর বয়সে কবিতা রচনায় হাতেখড়ি হয় তাঁর। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর (১৮৩৫-১৮৯৪) অনুসারী কবি। তাঁর ‘কবিকাহিনী’ (১৮৭৮), ‘বনফুল’ (১৮৮০) ও ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘সন্ধ্যাসংগীত’ (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রকাশিত হতে লাগল কবি রবীন্দ্রনাথের নিজের বাণী। এই পর্বের ‘সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’ (১৮৮৩), ‘ছবি ও গান’, ‘কড়ি ও কোমল’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪) কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানব হৃদয়ের বিষণ্ণতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ এবং তার পর প্রকাশিত ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কল্পনা’ (১৯০০) ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) কাব্যগ্রন্থে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রোম্যান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য লক্ষিত হয়। এই চিন্তা ধরা পড়েছে ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬), ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪) ও ‘গীতালি’ (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে। ১৯১৫ সালে বেজে উঠল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। আধ্যাত্মলোকের পরিবর্তে পুনরায় মর্ত্যলোকের দিকে তাকালেন কবি। এই নবদৃষ্টির ফসল ‘বলাকা’ (১৯১৬)। এরপর ‘পলাতকা’ (১৯১৮) কাব্যে গল্প-কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সমসাময়িক সমস্যাগুলি তুলে ধরেন। এরপর ‘পূরবী’ (১৯২৫) ও ‘মহুয়া’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ আবার ফিরে এলেন প্রেমের আশ্রয়ে। জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে প্রকাশিত হল ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য। তারপর জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ‘রোগশয্যায়’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১), ‘জন্মদিনে ‘(১৯৪১) ও ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১, মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন তিনি। শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ’ মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রতিফলিত হয় প্রাচীন উপনিষদ্, মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলি, কবীরের দোঁহা, লালন ও অন্যান্য বাউল কবিদের মানবতাবাদী গীতিকবিতা ও রামপ্রসাদ সেনের শাক্ত সাহিত্যের মর্মবাণী। প্রাচীন সাহিত্যের দুরূহতা পরিহার করে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছিলেন কাব্য রচনার এক সহজ, সরল ও সরস আঙ্গিক। আবার বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে কিছু পরীক্ষামূলক লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও বাস্তবতাবোধের প্রাথমিক আবির্ভাব প্রসঙ্গে নিজ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেছিলেন কবি। বহির্বিশ্বে তাঁর সর্বাপেক্ষা সুপরিচিত কাব্যগ্রন্থটি হল গীতাঞ্জলি। এ বইটির জন্যই তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি “গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ” রূপে।
ছোটো ছোটো দুঃখকথা
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্পগুলি রচনা করেছিলেন। গল্পগুলি উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের ‘সাধনা’ পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। গল্পগুচ্ছ সংকলনের অন্য গল্পগুলির অনেকগুলিই রচিত হয়েছিল রবীন্দ্রজীবনের ‘সবুজ পত্র’ পর্বে (১৯১৪–১৭; প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত পত্রিকার নামানুসারে)। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্প হল ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘নষ্টনীড়’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘হৈমন্তী’, ‘দেনাপাওনা’, ‘মুসলমানীর গল্প’ ইত্যাদি। শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ‘লিপিকা’, ‘সে’ ও ‘তিনসঙ্গী’ গল্পগ্রন্থে নতুন আঙ্গিকে গল্পরচনা করেছিলেন।
সমসাময়িক ঘটনাবলি, বাঙালি হিন্দু সমাজের নানা সমস্যা, আধুনিক ধ্যানধারণার খণ্ড খণ্ড ছবি উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের গল্পে। নানা শ্রেণির চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বৌদ্ধিক বিশ্লেষণই অনেক ক্ষেত্রে তাঁর গল্পের প্রধান বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছোটোগল্প চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের আকারে পুনঃসৃজিত হয়েছে। তাঁর গল্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়ণ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘তিন কন্যা’ (‘মনিহারা’, ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘সমাপ্তি’ অবলম্বনে) ও ‘চারুলতা’ (‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে), তপন সিংহ পরিচালিত ‘অতিথি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’[১৩৯], পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত ‘স্ত্রীর পত্র’ ইত্যাদি।
রডোডেনড্রনগুচ্ছ
রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখেছেন মাত্র তেরোটি। এগুলি হল: ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭), ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ (১৯০৮), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৬), ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪) ও ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)। বৌ-ঠাকুরাণীর হাট ও রাজর্ষি ঐতিহাসিক উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা। এরপর থেকে ছোটগল্পের মতো তাঁর উপন্যাসগুলিও মাসিকপত্রের চাহিদা অনুযায়ী নবপর্যায় বঙ্গদর্শন, প্রবাসী, সবুজ পত্র, বিচিত্রা প্রভৃতি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।
‘চোখের বালি’ উপন্যাসে এক অকাল-বিধবার অবৈধ প্রণয়কে কেন্দ্র করে একাধিক চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব প্রধান বিষয় হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘নৌকাডুবি’ও জটিল পারিবারিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখা। কিন্তু এই উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বদলে কাহিনির গতিশীলতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ‘গোরা’ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই উপন্যাসে ফুটে উঠেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ, সনাতন হিন্দু ও ব্রাহ্মসমাজের সংঘাত, ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের জটিলতা আরও সূক্ষ্মভাবে উঠে এসেছে তাঁর পরবর্তী ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসেও। ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটি রবীন্দ্রনাথের “ছোটগল্পধর্মী উপন্যাস”। ‘শেষের কবিতা’ প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাসের চালিকাশক্তি একটি বিশেষভাবে উপস্থাপিত প্রেমতত্ত্ব। স্ত্রীর অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্তি – এই বিষয়টিকে উপজীব্য করে রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বোন’ ও ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসদুটি লেখেন। এর মধ্যে প্রথম উপন্যাসটি মিলনান্তক ও দ্বিতীয়টি বিয়োগান্তক। রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ সমসাময়িক বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে একটি বিয়োগান্তক প্রেমের উপন্যাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’ ও ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’।
সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। এইসব প্রবন্ধে তিনি সমাজ, রাষ্ট্রনীতি, ধর্ম, সাহিত্যতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, সংগীত ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধগুলি ‘সমাজ’ (১৯০৮) সংকলনে সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সময়ে লেখা রাজনীতি-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়েছে ‘কালান্তর’ (১৯৩৭) সংকলনে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মভাবনা ও আধ্যাত্মিক অভিভাষণগুলি সংকলিত হয়েছে ‘ধর্ম’ (১৯০৯) ও ‘শান্তিনিকেতন’ (১৯০৯-১৬) অভিভাষণমালায়। রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে ‘ভারতবর্ষ’ (১৯০৬), ‘ইতিহাস’ (১৯৫৫) ইত্যাদি গ্রন্থে। ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬) ও ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদি ভারতীয় সাহিত্য ও আধুনিক সাহিত্যের সমালোচনা করেছেন যথাক্রমে ‘প্রাচীন সাহিত্য’ (১৯০৭) ও ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭) গ্রন্থদুটিতে। ‘লোকসাহিত্য’ (১৯০৭) প্রবন্ধমালায় তিনি আলোচনা করেছেন বাংলা লোকসাহিত্যের প্রকৃতি। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনা লিপিবদ্ধ রয়েছে ‘শব্দতত্ত্ব’ (১৯০৯), ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ (১৯৩৮) ইত্যাদি গ্রন্থে। ছন্দ ও সংগীত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন যথাক্রমে ‘ছন্দ’ (১৯৩৬) ও ‘সংগীতচিন্তা’ (১৯৬৬) গ্রন্থে। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তার কথা প্রকাশ করেছেন ‘শিক্ষা’ (১৯০৮) প্রবন্ধমালায়। ‘ন্যাশনালিজম’ (ইংরেজি, ১৯১৭) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের বিশ্লেষণ করে তার বিরোধিতা করেছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দর্শন বিষয়ে যে বিখ্যাত বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি ‘রিলিজিয়ন অফ ম্যান’ (ইংরেজি, ১৯৩০; বাংলা অনুবাদ ‘মানুষের ধর্ম’, ১৯৩৩) নামে সংকলিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা জন্মদিনের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ (১৯৪১) তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধগ্রন্থ। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘বিশ্বপরিচয়’ (১৯৩৭) নামে একটি তথ্যমূলক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২), ‘ছেলেবেলা’ (১৯৪০) ও ‘আত্মপরিচয়’ (১৯৪৩) তাঁর আত্মকথামূলক গ্রন্থ।
রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক পত্রসাহিত্য আজ পর্যন্ত উনিশটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘ছিন্নপত্র’ ও ‘ছিন্নপত্রাবলী’ (ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীকে লেখা), ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ (রানু অধিকারীকে (মুখোপাধ্যায়) লেখা) ও ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ (নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লেখা) বই তিনটি রবীন্দ্রনাথের তিনটি উল্লেখযোগ্য পত্রসংকলন।
কেহ বলে ড্রামাটিক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে ছিলেন নট ও নাট্যকার। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পারিবারিক নাট্যমঞ্চে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘হঠাৎ নবাব’ নাটকে (মলিয়ের লা বুর্জোয়া ‘জাঁতিরোম’ অবলম্বনে রচিত) ও পরে জ্যোতিরিন্দ্রনাথেরই ‘অলীকবাবু’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮১ সালে তাঁর প্রথম গীতিনাট্য ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে তিনি ঋষি বাল্মীকির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৮৮২ সালে রবীন্দ্রনাথ রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে ‘কালমৃগয়া’ নামে আরও একটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন।এই নাটক মঞ্চায়নের সময় তিনি অন্ধমুনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
গীতিনাট্য রচনার পর রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি কাব্যনাট্য রচনা করেন। শেকসপিয়রীয় পঞ্চাঙ্ক রীতিতে রচিত তাঁর ‘রাজা ও রাণী’ (১৮৮৯) ও ‘বিসর্জন’ (১৮৯০) বহুবার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হয় এবং তিনি নিজে এই নাটকগুলিতে অভিনয়ও করেন। ১৮৮৯ সালে ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে বিক্রমদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বিসর্জন’ নাটকটি দুটি ভিন্ন সময়ে মঞ্চায়িত করেছিলেন তিনি। ১৮৯০ সালের মঞ্চায়নের সময় যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধ রঘুপতির ভূমিকায় এবং ১৯২৩ সালের মঞ্চায়নের সময় বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ যুবক জয়সিংহের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কাব্যনাট্য পর্বে রবীন্দ্রনাথের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য নাটক হল চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২) ও মালিনী (১৮৯৬)।
কাব্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ প্রহসন রচনায় মনোনিবেশ করেন। এই পর্বে প্রকাশিত হয় ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘হাস্যকৌতুক’ (১৯০৭) ও ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ (১৯০৭)। ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ উপন্যাসটিকেও ‘চিরকুমার সভা’ নামে একটি প্রহসনমূলক নাটকের রূপ দেন।
১৯০৮ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রূপক-সাংকেতিক তত্ত্বধর্মী নাট্যরচনা শুরু করেন। ইতিপূর্বে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ (১৮৮৪) নাটকে তিনি কিছুটা রূপক-সাংকেতিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ সালের পর থেকে একের পর এক নাটক তিনি এই আঙ্গিকে লিখতে শুরু করেন। এই নাটকগুলি হল: ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘রাজা’ (১৯১০), ‘ডাকঘর’ (১৯১২), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬), ‘মুক্তধারা’ (১৯২২), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৬), ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩), ‘কালের যাত্রা’ (১৯৩২) ইত্যাদি। এই সময় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত শান্তিনিকেতনে মঞ্চ তৈরি করে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অভিনয়ের দল গড়ে মঞ্চস্থ করতেন। কখনও কখনও কলকাতায় গিয়েও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করতেন তিনি। এই সব নাটকেও একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১৯১১ সালে ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসী এবং ‘রাজা’ নাটকে রাজা ও ঠাকুরদাদার যুগ্ম ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৪ সালে ‘অচলায়তন’ নাটকে অদীনপুণ্যের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৫ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় অভিনয়; ১৯১৭ সালে ‘ডাকঘর’ নাটকে ঠাকুরদা, প্রহরী ও বাউলের ভূমিকায় অভিনয়। নাট্যরচনার পাশাপাশি এই পর্বে ছাত্রছাত্রীদের অভিনয়ের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পুরোন নাটকগুলি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ করে নতুন নামে প্রকাশ করেন। ‘শারদোৎসব’ নাটকটি হয় ‘ঋণশোধ’ (১৯২১), ‘রাজা’ হয় ‘অরূপরতন’ (১৯২০), ‘অচলায়তন’ হয় ‘গুরু’ (১৯১৮), ‘গোড়ায় গলদ’ হয় ‘শেষরক্ষা’ (১৯২৮), ‘রাজা ও রাণী’ হয় ‘তপতী’ (১৯২৯) এবং ‘প্রায়শ্চিত্ত’ হয় ‘পরিত্রাণ’ (১৯২৯)।
১৯২৬ সালে ‘নটীর পূজা’ নাটকে প্রথম অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচ ও গানের প্রয়োগ ঘটান রবীন্দ্রনাথ। এই ধারাটিই তাঁর জীবনের শেষ পর্বে “নৃত্যনাট্য” নামে পূর্ণ বিকাশ লাভ করে। নটীর পূজা নৃত্যনাট্যের পর রবীন্দ্রনাথ একে একে রচনা করেন ‘শাপমোচন’ (১৯৩১), ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩), ‘নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮) ও ‘শ্যামা’ (১৯৩৯)। এগুলিও শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরাই প্রথম মঞ্চস্থ করেছিলেন।
মনের কথার টুকরো
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি ‘রবীন্দ্রসংগীত’ নামে পরিচিত। ধ্রুপদি ভারতীয় সংগীত (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সংগীত), বাংলা লোকসংগীত ও ইউরোপীয় সংগীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন।রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসংগীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন। প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৮৮৪-১৯০০) পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। এই পর্বের রবীন্দ্রসংগীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা মধুকান, রামনিধি গুপ্ত, শ্রীধর কথক প্রমুখের প্রভাবও সুস্পষ্ট। এই সময় থেকেই তিনি স্বরচিত কবিতায় সুর দিয়ে গান রচনাও শুরু করেছিলেন। ১৯০০ সালে শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসংগীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানের অঙ্গীভূত করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়।,কবির এই সময়কার গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহ সুরসৃষ্টি। তাঁর রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থের ‘পূজা’, ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’, ‘স্বদেশ’, ‘আনুষ্ঠানিক’ ও ‘বিচিত্র’ পর্যায়ে মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয়েছিল। ইউরোপীয় অপেরার আদর্শে ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্য এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’, ও ‘শ্যামা’ সম্পূর্ণ গানের আকারে লেখা।
বিদ্রোহী পরমাণু
রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোকনৃত্য ও ধ্রুপদি নৃত্যশৈলীগুলির সংমিশ্রণে তিনি এক নতুন শৈলীর প্রবর্তন করেন। মূলত মণিপুরি রাসনৃত্য, গুজরাতি গড়বা নৃত্য, পাঞ্জাবি ভাঙড়া ও সিদ্ধা নৃত্যের রীতিগুলি মিশ্রিতভাবে গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে সিংহলের ক্যান্ডিনৃত্য এবং ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভা অঞ্চলের লোকনৃত্যের কয়েকটি চলন ও ভঙ্গিমাকে মিশিয়েছেন তাতে। সমবেত নাচের ক্ষেত্রে সাঁওতালি গোষ্ঠীনৃত্যের একটি আদল পাওয়া যায়। তবে ভরতনট্যম বা কথাকলির কয়েকটি ভঙ্গিমা ছাড়া আর কিছুই তিনি গ্রহণ করেননি। এই শৈলীটি ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যগুলিতে গানের পাশাপাশি নাচও অপরিহার্য। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর যে আধুনিক ভারতীয় নৃত্যধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তার পিছনেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণা ছিল।
চিত্ররেখাডোরে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন প্রায় সত্তর বছর বয়সে। চিত্রাঙ্কনে কোনো প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। প্রথমদিকে তিনি লেখার হিজিবিজি কাটাকুটিগুলিকে একটি চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই প্রচেষ্টা থেকেই তাঁর ছবি আঁকার সূত্রপাত ঘটে। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ কালপরিধিতে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের ওপর, যার ১৫৭৪টি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ছবিতে রং ও রেখার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথ সংকেতের ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য চিত্রকলার পুনরুত্থানে আগ্রহী হলেও, তাঁর নিজের ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। মূলত কালি-কলমে আঁকা স্কেচ, জলরং ও দেশজ রঙের ব্যবহার করে তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর ছবিতে দেখা যায় মানুষের মুখের স্কেচ, অনির্ণেয় প্রাণীর আদল, নিসর্গদৃশ্য, ফুল, পাখি ইত্যাদি। তিনি নিজের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন। নন্দনতাত্ত্বিক ও বর্ণ পরিকল্পনার দিক থেকে তাঁর চিত্রকলা বেশ অদ্ভুত ধরণেরই বলে মনে হয়। তবে তিনি একাধিক অঙ্কনশৈলী রপ্ত করেছিলেন। তন্মধ্যে, কয়েকটি শৈলী হল- নিউ আয়ারল্যান্ডের হস্তশিল্প, কানাডার (ব্রিটিশ কলম্বিয়া প্রদেশ) পশ্চিম উপকূলের “হাইদা” খোদাইশিল্প ও ম্যাক্স পেকস্টাইনের কাঠখোদাই শিল্প।
দর্শন
*
বিশ্বমায়ের আঁচল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল। সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করলেও তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং উক্ত ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁর চোখে ছিল “আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ”। তাই বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯১৬ সালের শেষ দিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটি হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী রবীন্দ্রনাথকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ উপস্থিত হওয়ায় তাঁদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বর্জন করেন। নাইটহুড প্রত্যাখ্যান-পত্রে লর্ড চেমসফোর্ডকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।” রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ও ‘একলা চলো রে’ রাজনৈতিক রচনা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘একলা চলো রে’ গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। যদিও মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। হিন্দু নিম্নবর্ণীয় জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেডকরের যে মতবিরোধের সূত্রপাত হয়, তা নিরসনেও রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
যেমন করে গাইছে আকাশ
‘তোতা-কাহিনী’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়ের মুখস্ত-সর্বস্ব শিক্ষাকে প্রতি তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। দেখিয়ে দেন, দেশের ছাত্রসমাজকে খাঁচাবদ্ধ পাখিটির মতো শুকনো বিদ্যা গিলিয়ে কীভাবে তাদের বৌদ্ধিক মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯১৭ সালের ১১ অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারা ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা সম্পর্কে প্রথাবিরুদ্ধ চিন্তাভাবনা শুরু করেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমকে দেশ ও ভূগোলের গণ্ডীর বাইরে বের করে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বেঁধে একটি বিশ্ব শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনাও এই সময়েই গ্রহণ করেছিলেন কবি। ১৯১৮ সালের ২২ অক্টোবর ‘বিশ্বভারতী’ নামাঙ্কিত তাঁর এই বিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছিল। এরপর ১৯২২ সালের ২২ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের। বিশ্বভারতীতে কবি সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেছিলেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য অর্থসংগ্রহ করতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে প্রাপ্ত সম্পূর্ণ অর্থ তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বিদ্যালয়ের পরিচালন খাতে। নিজেও শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ ও শিক্ষক হিসেবেও অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতেন তিনি। সকালে ছাত্রদের ক্লাস নিতেন এবং বিকেল ও সন্ধ্যায় তাদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা করতেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি একাধিকবার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণ করেন।
প্রাণের প্রদীপ
ধর্ম ও ঈশ্বরচেতনা রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কর্ম ও সাহিত্যের মধ্যেই নিহিত। তবে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা নন। তাঁর ধর্মও সমাজ-প্রচলিত মতবাদগুলির থেকে অনেকাংশে পৃথক। তাঁর ঈশ্বর কর্মী ঈশ্বর। তাঁর অবস্থান স্বর্গলোক নয়, মানবের সংসার। তাঁর মূর্তি নেই। মানুষের মধ্যেই তাঁর প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি “রূপসাগরের অরূপরতন”। তাঁর ধর্মও মানুষের ধর্ম। এই ধর্ম মানুষে-মানুষে ঐক্যবন্ধন করতে শেখায়। এই দর্শন সৌভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়। রবীন্দ্রনাথ আজীবন ধর্মীয় উন্মাদনার বিরোধিতা করে এসেছেন। যে ধর্ম মানুষে-মানুষে ঘৃণার বীজ রোপণ করে, যে ধর্ম সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে সংঘাত-প্রতিঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে, যে ধর্ম আমাদের সামাজিক ঐক্যকে খণ্ডবিখণ্ড করে, রবীন্দ্রনাথ বরাবর সেই ধর্মের বিরোধিতা করে এসেছেন। তাঁর এই দর্শন এক অখণ্ড মানবতাবাদের নিদর্শন। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মিশতে চেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে। সারা জীবন গেয়েছিলেন মানুষের জয়গান, জীবনের জয়গান।

(বাংলা উইকিপিডিয়ায় আমার লেখা “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” নিবন্ধটি সামান্য পরিবর্তন করে এখানে দেওয়া হয়েছে।)

শনিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১২

‘সাহিত্যের মাত্রা’


কল্যাণীয়েষু,—শ্রাবণের [১৩৪০] ‘পরিচয়’ পত্রিকায় শ্রীমান্‌ দিলীপকুমারকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র—সাহিত্যের মাত্রা—সম্বন্ধে তুমি [‘পরিচারক’-সম্পাদক শ্রীঅতুলানন্দ রায়] আমার অভিমত জানতে চেয়েছ। এ চিঠি ব্যক্তিগত হলেও যখন সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তখন এরূপ অনুরোধ হয়ত করা যায়, কিন্তু অনেক চার-পাতা-জোড়া চিঠির শেষছত্রের ‘কিছু টাকা পাঠাইবার’ মত এরও শেষ ক’লাইনের আসল বক্তব্য যদি এই হয় যে, ইয়োরোপ তার যন্ত্রপাতি, ধন-দৌলত, কামান-বন্দুক, মান-ইজ্জত সমেত অচিরে ডুববে, তবে অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে এই কথাই মনে করবো যে, বয়েস ত অনেক হ’ল, ও-বস্তু কি আর চোখে দেখে যাবার সময় পাব!

কিন্তু এদের ছাড়াও কবি আরও যাদের সম্বন্ধে হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তোমাদের সন্দেহ তার মধ্যে আমিও আছি। অসম্ভব নয়। এ প্রবন্ধে কবির অভিযোগের বিষয় হ’ল ওরা ‘মত্ত হস্তী’, ‘ওরা বুলি আওড়ালে’, ‘পালোয়ানি করলে’, ‘কসরৎ কেরামত দেখালে’, ‘প্রব্লেম সল্‌ভ করলে’, ‘অতএব ওদের’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই কথাগুলো যাদেরকেই বলা হোক, সুন্দরও নয়, শ্রুতিসুখকরও নয়। শ্লেষবিদ্রূপের আমেজে মনের মধ্যে একটা ইরিটেশান আনে। তাতে বক্তারও উদ্দেশ্য যায় ব্যর্থ হয়ে, শ্রোতারও মন যায় বিগড়ে। অথচ ক্ষোভপ্রকাশ যেমন বাহুল্য, প্রতিবাদও তেমন বিফল। কার তৈরি-করা বুলি পাখির মত আওড়ালুম, কোথায় পালোয়ানি করলুম, কি ‘খেল্‌’ দেখালুম, ক্রুদ্ধ কবির কাছে এ-সকল জিজ্ঞাসা অবান্তর। আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। খেলার মাঠে কেউ রব তুলে দিলেই হল অমুক গু মাড়িয়েছে। আর রক্ষে নেই,—কোথায় মাড়ালুম, কে বললে, কে দেখেচে, ওটা গু নয়, গোবর—সমস্ত বৃথা। বাড়ি এসে মায়েরা না নাইয়ে, মাথায় গঙ্গাজলের ছিটে না দিয়ে আর ঘরে ঢুকতে দিতেন না। কারণ, ও যে গু মাড়িয়েচে! এও আমার সেই দশা। 

‘সাহিত্যের মাত্রা’ই বা কি, আর অন্য প্রবন্ধই বা কি, এ কথা অস্বীকার করিনে যে, কবির এই ধরনের অধিকাংশ লেখাই বোঝবার মত বুদ্ধি আমার নেই। তাঁর উপমা উদাহরণে আসে কল – কবজা, আসে হাট-বাজার, হাতি-ঘোড়া, জন্তু-জানোয়ার—ভেবেই পাইনে মানুষের সামাজিক সমস্যায় নরনারীর পরস্পরের সম্বন্ধবিচারে ওরা সব আসেই বা কেন এবং এসেই বা কি প্রমাণ করে? শুনতে বেশ লাগসই হলেই ত তা যুক্তি হয়ে ওঠে না।

একটা দৃষ্টান্ত দিই। কিছুদিন পূর্বে হরিজনদের প্রতি অবিচারে ব্যথিত হয়ে তিনি প্রবর্তক-সঙ্ঘের মতিবাবুকে একখানা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে অনুযোগ করেছিলেন যে, ব্রাহ্মণীর পোষা বিড়ালটা এঁটো-মুখে গিয়ে তাঁর কোলে বসে, তাতে শুচিতা নষ্ট হয় না—তিনি আপত্তি করেন না। খুব সম্ভব করেন না, কিন্তু তাতে হরিজনদের সুবিধা হল কি? প্রমাণ করলে কি? বিড়ালের যুক্তিতে এ কথা ত ব্রাহ্মণীকে বলা চলা না যে, যে-হেতু অতিনিকৃষ্ট-জীব বেড়ালটা গিয়ে তোমার কোলে বসেছে, তুমি আপত্তি করোনি, অতএব অতি-উৎকৃষ্ট-জীব আমিও গিয়ে তোমার কোলে বসব, তুমি আপত্তি করতে পারবে না। বেড়াল কেন কোলে বসে, পিঁপড়ে কেন পাতে ওঠে, এ-সব তর্ক তুলে মানুষের সঙ্গে মানুষের ন্যায়-অন্যায়ের বিচার হয় না। এ-সব উপমা শুনতে ভাল, দেখতেও চকচক করে, কিন্তু যাচাই করলে দাম যা ধরা পড়ে, তা অকিঞ্চিৎকর। বিরাট ফ্যাক্টরীর প্রভূত বস্তুপিণ্ড উৎপাদনের অপকারিতা দেখিয়ে মোটা নভেলও অত্যন্ত ক্ষতিকর, এ কথা প্রতিপন্ন হয় না।

আধুনিককালের কল-কারখানাকে নানা কারণে অনেকেই আজকাল নিন্দে করেন, রবীন্দ্রনাথও করেছেন—তাতে দোষ নেই। বরঞ্চ ওইটেই হয়েছে ফ্যাশন। এই বহু-নিন্দিত বস্তুটার সংস্পর্শে যে মানুষগুলো ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয় এসে পড়েছে, তাদের সুখ-দুঃখের কারণগুলোও হয়ে দাঁড়িয়েছে জটিল—জীবন-যাত্রার প্রণালীও গেছে বদলে, গাঁয়ের চাষাদের সঙ্গে তাদের হুবহু মেলে না। এ নিয়ে আপসোস করা যেতে পারে, কিন্তু তবু যদি কেউ এদেরই নানা বিচিত্র ঘটনা নিয়ে গল্প লেখে, তা সাহিত্য হবে না কেন? 

কবিও বলেন না যে হবে না। তাঁর আপত্তি শুধু সাহিত্যের মাত্রা লঙ্ঘনে। কিন্তু এই মাত্রা স্থির হবে কি দিয়ে? কলহ দিয়ে, না কটুকথা দিয়ে? কবি বলেছেন—স্থির হবে সাহিত্যের চিরন্তন মূল নীতি দিয়ে। কিন্তু এই ‘মূল নীতি’ লেখকের বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ও স্বকীয় রসোপলব্ধির আদর্শ ছাড়া আর কোথাও আছে কি? চিরন্তনের দোহাই পাড়া যায় শুধু গায়ের জোরে আর কিছুতে নয়। ওটা মরীচিকা।

কবি বলছেন, “ উপন্যাস-সাহিত্যেরও সেই দশা। মানুষের প্রাণের রূপ চিন্তার স্তূপে চাপা পড়েছে।” কিন্তু প্রত্যুত্তরে কেউ যদি বলে, “উপন্যাস-সাহিত্যের সে দশা নয়, মানুষের প্রাণের রূপ চিন্তার স্তূপে চাপা পড়েনি, চিন্তার সূর্যালোকে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে,” তাকে নিরস্ত করা যাবে কোন্‌ নজির দিয়ে? এবং এরই সঙ্গে আর একটা বুলি আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, তাতে রবীন্দ্রনাথও যোগান দিয়েছেন এই বলে যে, “যদি মানুষ গল্পের আসরে আসে, তবে সে গল্পই শুনতে চাইবে, যদি প্রকৃতিস্থ থাকে।” বচনটি স্বীকার করে নিয়েও পাঠকেরা যদি বলে—হাঁ, আমরা প্রকৃতিস্থই আছি, কিন্তু দিন-কাল বদলেছে এবং বয়েসও বেড়েছে; সুতরাং রাজপুত্র ও ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্পে আমাদের মন ভরবে না, তা হলে জবাবটা যে তাদের দুর্বিনীত হবে, এ আমি মনে করিনে। তারা অনায়াসে বলতে পারে, গল্পে চিন্তাশক্তির ছাপ থাকলেই তা পরিত্যাজ্য হয় না কিংবা বিশুদ্ধ গল্প লেখার জন্যে লেখকের চিন্তাশক্তি বিসর্জন দেবারও প্রয়োজন নাই।

কবি মহাভারত ও রামায়ণের উল্লেখ করে ভীষ্ম ও রামের চরিত্র আলোচনা করে দেখিয়েছেন, ‘বুলি’র খাতিরে ও-দুটো চরিত্রই মাটি হয়ে গেছে। এ নিয়ে আমি আলোচনা করব না, কারণ ও-দুটো গ্রন্থ শুধু কাব্যগ্রন্থই নয় ধর্মপুস্তক ত বটেই, হয়ত বা ইতিহাসও বটে। ও-দুটি চরিত্র কেবলমাত্র সাধারণ উপন্যাসের বানানো চরিত্র নাও হতে পারে, সুতরাং সাধারণ কাব্য-উপন্যাসের গজকাঠি নিয়ে মাপতে যেতে আমার বাধে।
চিঠিটায় ইন্‌টালেক্‌ট শব্দটার বহু প্রয়োগ আছে। মনে হয় যেন কবি বিদ্যে ও বুদ্ধি উভয় অর্থেই শব্দটার ব্যবহার করেছেন। প্রব্লেম শব্দটাও তেমনি। উপন্যাসে অনেক রকমের প্রব্লেম থাকে, ব্যক্তিগত, নীতিগত, সামাজিক, সাংসারিক, আর থাকে গল্পের নিজস্ব প্রব্লেম, সেটা প্লটের। এর গ্রন্থিই সবচেয়ে দুর্ভেদ্য। কুমার সম্ভবের প্রব্লেম, উত্তরকাণ্ডে রামভদ্রের প্রব্লেম, ডল্‌স হাউসের নোরার প্রব্লেম, অথবা যোগাযোগের কুমুর প্রব্লেম একজাতীয় নয়। যোগাযোগ বইখানা যখন ‘বিচিত্রা’য় চলছিল এবং অধ্যায়ের পর অধ্যায় কুমু যে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল, আমি ত ভেবেই পেতুম না ঐ দুর্ধর্ষ প্রবলপরাক্রান্ত মধুসূদনের সঙ্গে তার টাগ-অফ-ওয়ারের শেষ হবে কি করে? কিন্তু কে জানত সমস্যা এত সহজ ছিল—লেডি ডাক্তার মীমাংসা করে দেবেন একমুহূর্তে এসে। আমাদের জলধর দাদাও প্রব্লেম দেখতে পারেন না, অত্যন্ত চটা। তাঁর একটা বইয়ে এমনি একটা লোক ভারী সমস্যার সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু তার মীমাংসা হয়ে গেল অন্য উপায়ে। ফোঁস করে একটা গোখরো সাপ বেরিয়ে তাকে কামড়ে দিলে। দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, এটা কি হল? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, কেন, সাপে কি কাউকে কামড়ায় না?

পরিশেষে আর একটা কথা বলবার আছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ইব্‌সেনের নাটকগুলি ত একদিন কম আদর পায়নি, কিন্তু এখনি কি তার রং ফিকে হয়ে আসেনি, কিছুকাল পরে সে কি আর চোখে পড়বে?” না পড়তে পারে, কিন্তু তবুও এটা অনুমান, প্রমাণ নয়। পরে একদিন এমনও হতে পারে, ইব্‌সেনের পুরানো আদর আবার ফিরে আসবে। বর্তমান কালই সাহিত্যের চরম হাইকোর্ট নয়





(শ্রী  শরৎচন্দ্র )




বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১২

দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

সদাচারী হতে হলে আমাদেরকে আমাদের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। আসলে দৃষ্টিভঙ্গিটা কি? দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে আপনার চিন্তা চেতনার দিক। আপনি কোন দিকে ভাবছেন । আপনার কিন্তু ভাববার ও কাজ করবার যথেষ্ট ¯^vaxbZv রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সেভাবেই তৈরী করেছেন। আর এই ভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে পরিচালিত করতে পারে ভালোর দিকে বা খারাপের দিকে। দৃষ্টিভঙ্গির একটা সাধারন উদাহরন হতে পারে এইরকম : ধরুন আধা গেলাস পানি। দুজন মানুষ এই পানির গেলাসটার দিকে তাকিয়ে আছে । একজন বলল এই গেলাসটি অর্ধেক খালি। আরেকজন বলল , এই গেলাসিটি অর্ধেক ভরা । তাহলে একই জিনিস দুজন মানুষ কিন্তু দুভাবে দেখেছে। এটাই হলো দৃষ্টিভঙ্গরি পার্থক্য। দৃষ্টিভঙ্গি কে আমরা নিয়্ত ও বলতে পারি। রসুলুল্লাহ (সা) এর একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস হচ্ছে - 'নিয়ত সকল কর্মের অঙ্কুর' । অর্থ্যাৎ নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে ভালোর দিকে কিংবা খারাপের দিকে চিন্তা করতে সাহায্য করে। আপনি কি রিঅ্যাকটিভ হবেন না প্রো-এ্যাকটিভ হবেন তা নির্ধারিত হবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। জীবনকে আপনি ইতিবাচক না নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন সেটা নির্ধারণ করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তার পরিবর্তনের জন্য প্রথম প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সদাচারণের সম্পর্ক কি? আপনি যদি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন বা ধারণ করতে শেখেন , তাহলে আপনি সহজেই একজন সদাচারী মানুষে রূপান্তরিত হতে পারবেন। যেমন , কোন মানুষের প্রতি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক, তাহলে আপনি কি মনে প্রানে তার সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারবেন? ভালো ব্যবহারটা তখনই সম্ভব যখন আপনি আপনার সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ইতিবাচক করে তুলতে পারবেন। জীবনের যে কোন ঘটনাকে বিশ্লেষন করলে আপনি তার মধ্যে থেকে ভালো বা খারাপ উভয় দিকই বের করতে পারবেন। যেমন ধরুন , আপনার চাকুরী চলে গেলো। এটা একটা খারাপ ঘটনা। কিন্তু আপনি যদি এই ব্যপারটাকেই ইতিবাচক হিসাবে ধরে নতুন চাকুরীর চেষ্টা করেন, তাহলে আপনি এর চেয়েও ভালো চাকুরীর সন্ধান পেতে পারেন । আর বিষয়টাকে আপনি আপনার জীবনের শেষ হিসাবে ধরে নিলে সামনে এগোনোই দুস্কর হয়ে যাবে।
সুতারং আপনি ভালো হবেন কিনা বা নিজের পরিবর্তন করবেন কিনা তার একটা বড় নিয়ামক হচ্ছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যদি নিজের ও অপরের পরিবর্তনের পক্ষে হয়, তাহলে আপনার পক্ষে সদাচারী হওয়া বা সদাচারী মানুষ ও সমাজ গড়ে তোলা খুবই সহজ।
যুদ্ধটা হচ্ছে ‌'আমি যেমন আছি তেমন থাকবো' আর 'আমি পরিবর্তন হবো, সদাচারী হবো' - এই দুই আমির মধ্যে। আর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই এই দুই আমির মধ্যে পার্থক্য গড়ে তুলবে, আমাদেরক সদাচারী মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে এবং আমাদেরকে পরিবর্তন হতে সাহায্য করবে।
ধন্যবাদ সবাইকে।

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

কিছু কথা ... অবশ্য না পড়লেও হয় !

একটি জরুরী সার্জারির জন্য তাড়াহুড়ো করে এক ডাক্তারকে হাসপাতালে ডেকে পাঠানো হল...সে তড়িৎ গতিতে হাসপাতালে পৌঁছে গেলো...হাসপাতালে ঢুকেই সে নিজেকে দ্রুত প্রস্তুত করে নিল সার্জারির জন্য..

এরপর সার্জারির ব্লক এ গিয়ে সে দেখল রোগীর ( একটি ছোট্ট ছেলে ) বাবা ওখানে পায়চারি করছে ডাক্তারের অপেক্ষায় , ডাক্তার কে দেখামাত্র লোকটি চেঁচিয়ে উঠল- আপনার আ...সতে এত দেরি লাগে? দায়িত্ববোধ বলতে কিছু আছে আপনার? আপনি জানেন আমার ছেলে এখানে কতটা শোচনীয় অবস্থায় আছে ?

ডাক্তার ছোট্ট একটা মুচকি হাসি হেসে বলল- " আমি দুঃখিত, আমি হাসপাতাল এ ছিলাম না, বাসা থেকে তাড়াহুড়ো করে এলাম, তাই খানিক দেরি হল, এখন আপনি যদি একটু শান্ত হন, তবে আমি আমার কাজ টা শুরু করি?

লোকটি এবার যেন আরও রেগে গেলো, ঝাঁঝাঁলো স্বরে বলল- " ঠাণ্ডা হব? আপনার সন্তান যদি আজ এখানে থাকতো? আপনার সন্তান যদি জীবন মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতো, তবে আপনি কি করতেন? শান্ত হয়ে বসে থাকতেন??

ডাক্তার আবার হাসলেন আর বললেন " আমি বলব পবিত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে মাটি থেকেই আমাদের সৃষ্টি আর মাটিতেই আমরা মিসে যাব! ডাক্তার কাউকে দীর্ঘ জীবন দান করতে পারেন না... আপনি আপনার সন্তান এর জন্য প্রার্থনা করতে থাকুন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব...

লোকটি পুনরায় রাগত স্বরে বলল- অন্যকে উপদেশ দেয়া খুবই সহজ...আপনার এমন পরিস্থিথী হলে বুঝতেন...

এরপর ডাক্তার সার্জারির রুম এ চলে গেলো, ২ ঘণ্টার মত লাগলো , শেষে হাসি মুখে ডাক্তার হাসি মুখে বের হয়ে এলেন, "আলহামদুলিল্লাহ অপারেশন সফল" এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই ডাক্তার আবার বলে উঠলেন- আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে নার্স কে জিজ্ঞেস করুন, বলে তিনি চলে গেলেন...

এরপর লোকটি নার্স কে বললেন- এই ডাক্তার এত নিষ্টুর কেন? তিনি কি আর কিছুক্ষণ এখানে থাকতে পারতেন না...আমি ওনাকে আমার সন্তান এর ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতাম...!

তখন নার্স জানালেন- ডাক্তার এর ছেলে আজ সকালে মারা গেছেন রোড এক্সিডেন্ট এ, তিনি আপনার ফোন পেয়ে ওনার ছেলের জানাজা থেকে উঠে এসেছেন , এখন আবার দৌড়ে চলে গেলেন- কবর দিতে..!

Moral- একজন মানুষ কে কখনও তার বাইরের আচরন দেখে যাচাই করবেন না, কারন আপনি কখনই জানেন না তিনি কিসের মাঝে আছেন !

দৃষ্টিভঙ্গি মানে কী? দৃষ্টিভঙ্গি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

জীবনদৃষ্টি বা দৃষ্টিভঙ্গি কথাটার মানে হচ্ছে জীবনকে আমি কীভাবে দেখছি। জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি কী বা জীবন সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত কেমন হওয়া উচিত এসব বিষয়ে একটা সুস্পষ্ট অভিমত। আর জীবনকে সুন্দর করার জন্যে যে একটি জিনিসের প্রয়োজন, তাহলো সঠিক জীবনদৃষ্টি। বাকি সবকিছু তখন এমনিই চলে আসে। কারণ চাবিটা যদি ঠিক থাকে আপনি তালাটা খুলতে পারবেন। তা নাহলে যত চাবি থাকুক আপনার কাছে, এটা যদি ঐ তালার চাবি না হয়, তাহলে সেই তালা খোলা যাবে না। জীবনের তালা, জীবনের বদ্ধ দরজা খোলার জন্যে যে সঠিক চাবিটি দরকার সেই চাবিটি অর্জন করার জন্যে প্রয়োজন সঠিক জীবনদৃষ্টি।
আসলে সকল বাস্তবতার নির্মাতা মস্তিষ্ককে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন সুসংহত মানসিক প্রস্ত্ততি। আর মানসিক প্রস্ত্ততির ভিত্তি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ত বা অভিপ্রায়। কারণ মন পরিচালিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত দ্বারা। আর মস্তিষ্ককে চালায় মন। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা করেছেন মন ও মস্তিষ্কের সম্পর্ক নিয়ে। ডা. এলেন গোল্ডস্টেইন, ডা. জন মটিল, ডা. ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড ও ডা. ই রয় জন দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার। নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্ম প্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়। নতুন বাস্তবতা ভাল হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রাম-এর ভাল-মন্দের উপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস ক্ষতিকর বাস্তবতা উপহার দেয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত।
বিজ্ঞানীরা বলেন দৃষ্টিভঙ্গি দুধরনের। এক. প্রো-একটিভ। দুই. রি-একটিভ। প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে যে কোন পরিস্থিতিতে উত্তেজিত বা আবেগপ্রবণ না হয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত ও প্রদক্ষেপ গ্রহণ। প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে অন্যের কাজের প্রতিক্রিয়া হিসেবে কোনো কাজ বা আচরণ না করা। সর্বাবস্থায় নিজের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আচরণ ও কর্মপন্থা অবলম্বন করা। প্রো-একটিভ অর্থ হচ্ছে কি কি নেই তা নিয়ে হা-হুতাশ না করে যা আছে তা নিয়েই সুপরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করা। প্রো-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় সাফল্য ও বিজয় ছিনিয়ে আনে।
অপরদিকে রি-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ব্যর্থতা, হতাশা ও অশান্তি সৃষ্টি করে। রি-একটিভ হলে নিয়ন্ত্রণ তখন নিজের হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। আপনি যখন অন্যের কথায় কষ্ট পান, অন্যের কথায় রেগে যান, অন্যের আচরণে ক্রোধে ফেটে পড়েন, অন্যের তোষামোদিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, অন্যের চাটুকারিতায় গলে যান, অন্যের কথায় নাচেন, তখন নিয়ন্ত্রণ আর আপনার হাতে থাকে না। নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে।


( Collected )

রবিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১২

জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের টিউটোরিয়াল

দুনিয়াটা একটা জীবনের খেলাঘর। কি চমকে দিলাম নাকি ???? এই কথাটি বলে??? প্রিয় পাঠকঃ সত্যিই কি আপনাদের চিন্তা হয় না যে জীবনের খেলাঘরে আমরা খেলছি কেবল কাঠের পুতুলের মত। আমরা খেলছি দুনিয়ার চাওয়া পাওয়া,লাভ লোকসান নিয়ে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন আমরা যে এই দুনিয়ায় এসেছি তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি???? কি উদ্দেশে মহান আল্লাহ্‌ আমাদের সৃষ্টি করেছেন??? এবং আমরা দুনিয়ায় এসে কতটুকুই বা আমাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছি??? কতটুকুই বা কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করে জীবনের পথে চলছি ??? আমি বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদ ও ইসলামী বক্তা ডাঃ জাকির নায়েকের "আমাদের জীবনের লক্ষ্য" সম্পর্কিত আলোচনা শুনে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। যা আমাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে। আর দেরি না করে চলুন আলোচনায় চলে যাই......
আজকে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ কি চিন্তা করে জানেন????? অনেক টাকা বেতনের চাকরি করবো, আয়ের ভিত্তিতে চলাফেরা খাওয়া, দাওয়া , পোশাক আশাক পড়বো। এই তো জীবন। আর কি কিছু দরকার আছে জীবনে?????
যেকোনো মানুষের জীবনে লক্ষ্যটা নির্ধারণ করা কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার।কারণ লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই কাজের ডালপালা, শাখা প্রশাখা সম্প্রসারিত হয়। আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা সবসময় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আবার কেউ বাবা মাকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে, আবার কেউ স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছা কে বেশি মূল্য দেয়, আবার কেউ সন্তানের চাওয়া পাওয়াকে তার জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচনা করে কাজ করতে থাকে। আবার কেউ কেউ আছে প্রতিবেশী কেন্দ্রিক, প্রতিবেশীর সাথে সবসময় প্রতিযোগিতা করায় ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ আছে বন্ধুদের সাথে প্রতিযোগিতা করায় সদা ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ নিজের শত্রুদের বিরুদ্ধে সারাদিন পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে প্রতিশোধ তোলা যায়। অর্থাৎ "ইটের জবাব পাথরের মাধ্যমে দিতে হবে" এই চিন্তায় সদা ব্যস্ত। হায়রে সমাজ!!!!!! একি তোমার বেহাল দশা???? এটাই কি আশান্বিত???? হ্যায় চলছে সমাজের চাকা। আমরা কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছি এ চাকায়।
প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বক্তা ডাঃ জাকির নায়েক মানুষের জীবনের লক্ষ্যকে এভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। ইসলামিক এর পুরো অর্থ বিশ্লেষণ করলেই আমরা এর উত্তর পেয়ে যাবো। "আই"<b></b> দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন "ইসলামিক" অর্থাৎ মানুষের লক্ষ্য অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে হওয়া বাঞ্ছনীয়।"এস" দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন "প্যাসিফিক"। একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হতে পারে। যেমনঃ কোন শিক্ষক পাখী শিকারের শিক্ষা দিচ্ছিলেন ছাত্রদের। তিনি ছাত্রদের বললেন..." আমি যতক্ষণ না বলবো তোমরা তীর ধনুক পাখিটির দিকে তাক করে থাকবে কিন্তু তীর ছুড়বে না"।তারপর শিক্ষক ছাত্রদের একে একে প্রশ্ন করলেন। প্রথম ছাত্রকে বললেন," তুমি কি দেখতে পাচ্ছ???"তখন সে উত্তর দিল আমি বন,গাছ,ও পাখিটি দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয় জনকে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর দিল" আমি গাছ,গাছের ডালপালা ও পাখিটিকে দেখতে পাচ্ছি। তারপর তৃতীয় ছাত্রকে একই প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর দিলঃ" আমি গাছের ডালপালা, পাখিটি,এবং পাখিটির চোখ দেখতে পাচ্ছি। ৪র্থ ছাত্রকে যখন প্রশ্ন করা হলো তখন সে উত্তর দিলঃ''আমি শুধু পাখিটির চোখ দেখতে পাচ্ছি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না"।সুতরাং এইরকম ৪র্থ ছাত্রের মতো জীবনের লক্ষ্য অবশ্যই নিদৃষটো হতে হবে। মানুষের জীবনের লক্ষ্য অবশ্যই লুকরেটিভ অর্থাৎ লাভজনক হতে হবে এই দুনিয়ার জন্য পাশাপাশি পরকালের আযাব থেকে মুক্তি দানের জন্য। কিন্তু পরকালের মুক্তির বিষয়টিই এখানে প্রাধান্য পাবে। মহান আল্লাহ্‌ সূরা বাকারাহ এর ২০১ নম্বর আয়াতে বলেছেন......আবার এমন কতক লোক আছে যারা বলে"হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে মঙ্গল দান কর এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা কর।"
মানুষের লক্ষ্য অবশ্যই''এপ্রোপ্রিয়েট" অর্থাৎ যথোপোযুক্ত হতে হবে। লক্ষ্য অবশ্যই "মেজারেবল" অর্থাৎ পরিমাপযোগ্য হতে হবে। যেমনঃকোন স্থপতি যদি মনে করেন যে সে দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু দালান নির্মাণ করতে চান। এক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ হিসেবে আবুধাবিতে যে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং আছে তার চেয়ে উঁচু বিল্ডিং তৈরির কথা বলতে পারেন।লক্ষ্য অবশ্যই "ইনটেনশন" এর উপর নির্ভরশীল।নিয়তের উপর নির্ভর করেই প্রতিটি কাজ সম্পাদিত হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিয়ত অবশ্যই আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন হতে হবে। লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে "কনসিসটেনন্সি" রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।যেমনঃ কোন ব্যক্তি যদি মনে করেন যে পুরো রমজানের ৩০ দিনে প্রতিদিন একটু একটু করে কুরআন পড়বেন। ধারাবাহিকভাবে পড়তে পড়তে রমজান শেষে দেখা যাবে কুরআন পড়া শেষ হয়েছে। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই যদি তার লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তবে লক্ষ্য অবশ্যই অর্জিত হয় বলে আশা করা যায়।
এক্ষেত্রে ডাঃ জাকির নায়েক পোলিওতে আক্রান্ত ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে সোনাজয়ী উইলমা রুডলফ্‌ এর ঘটনাটিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন।উইলমা ছিল মূলত প্রতিবন্ধী একজন শিশু।উইলমার মা সবসময় উইলমাকে সাহস যোগাতো জীবনে চলার পথে। মার প্রেরণায়ই তার বয়স যখন ৯-১৩ বছরের মধ্যে তখন সে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং লাস্ট হয়।তারপর উইলমা একসময় ১৯৬০ সালের অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয় এবং দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।একে একে সে ১০০ মিটার দৌড়, ২০০ মিটার স্প্রিনট্‌, ৪০০ মিটার রীলে সবগুলোতেই অংশগ্রহণ করে ৩টি স্বর্ণপদক অর্জন করে। যা ছিল মূলত ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় একটি সত্য ঘটনা।
এখন যে বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে তা হলো তার লক্ষ্য "ইসলামিক" ছিল কিনা?????? "আই" মানে ইসলামিক বিধিনিষেধ মেনে কুরআন ও সুন্নাহ্‌ মোতাবেক ছিল কিনা??? মনে হয়না তার লক্ষ্য কুরআন ও সুন্নাহ্‌ মোতাবেক ছিল।''এস" দ্বারা স্পেসিফিক অর্থাৎ তার লক্ষ্য কি নিদৃষ্ট ছিল??? অবশ্যই । তার লক্ষ্য ছিল দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা। "এল" দ্বারা বুঝানো হয়েছে তার লক্ষ্য কতটা লুকরেটিভ ছিল???? অর্থাৎ তার প্রধান উদ্দেশ্য কি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন???? এটা ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ উইলমা তার অর্জিত স্বর্ণপদকসমূহ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সমর্পণ না করে।"এ" দ্বারা বুঝানো হয়েছে লক্ষ্য "এপ্রোপ্রিয়েট" ছিল কিনা??? উইলমার লক্ষ্য অবশ্যই যথোপযুক্ত ছিল।কারণ তার লক্ষ্য ছিল দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করা।"এম" দ্বারা বুঝানো হয়েছে তা "মেজারেবল" বা পরিমাপযোগ্য কিনা???? হ্যায় অবশ্যই তা পরিমাপযোগ্য। "আই'' দ্বারা "ইনটেনশনকে" বুঝানো হয়েছে। যদি উইলমার "ইনটেনশন" থেকে থাকে খ্যাতি অর্জন করা তবে তা সে অবশ্যই পেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন করেছে কিনা তা আমরা জানিনা।"সি" দ্বারা এখানে "কনসিসটেনন্সি" বা "ধারাবাহিকতাকে" বোঝানো হয়েছে। উইলমা তার লক্ষ্য অর্জনে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করেছে কিনা???? হ্যায় তার চেষ্টায় ধারাবাহিকতা ছিল।
আর একজন ব্যক্তির কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন ''শেখ আহামেদ দিদাদ"।যিনি ডাঃ জাকির নায়েককে শারীরিক ডাক্তার থেকে মানুষের মনের ডাক্তারে রূপান্তরিত করেছেন। শেখ আহামেদ দিদাদ খুবই সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। তিনি বিক্রেতার চাকুরী করতেন। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় তিনি তার পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন। তিনি ইন্ডিয়াতে জন্ম নিয়েও মাতৃভূমি ছেড়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় যেয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি খ্রিষ্টান পাদ্রীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের স্বীকার হন। তখন তিনি চিন্তা করলেন এই সকল খ্রিষ্টান পাদ্রীদের যথোপযুক্ত উপায়ে উত্তর দেওয়া প্রয়োজন। এরই প্রেক্ষিতে তিনি মাওলানা " ''রাহমতুল্লাহ কারানভির" "ইজহারুল হক"বইটি পড়লেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের মূল বিষয়গুলোও পড়লেন। এইভাবে তিনি আল্লাহ্‌র পথে সংগ্রামে লিপ্ত থেকে কাজ করতে থাকলেন। তারপর ১৯৮৪ সালে তিনি তখনকার দিনের প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান বক্তা ''রেভারেঞ্জ জিমি সেগাটের"সাথে বিতর্ক করেন।দেখা যায় আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবানীতে তিনি জিমি সেগাটের আক্রমণের যথোপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম হন।
আর এখন যে বিষয়টা আসবে তা হল তার লক্ষ্য আদৌ  ''ইসলামিক" ছিল কিনা???
"আই"- কুরআন ও সাহি হাদিস মোতাবেক ছিল???? হ্যা অবশ্যই।''এস''- ''স্পেসিফিক" ছিল কি??? হ্যায় অবশ্যই শুনিদৃষ্ট ছিল। যেমনঃ তার লক্ষ্য ছিল ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে যে ভুলভ্রান্তি ছিল তা দূর করতে সাহায্য করা এবং যথাযথ জবাব নিশ্চিত করা।''এল"-''লুকরেটিভ" অর্থাৎ লাভজনক ছিল কি???? প্রথমত আখিরাত ও দ্বিতীয়ত দুনিয়ার জন্য। হ্যায় অবশ্যই তা ছিল। ১৯৮৬ সালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ''কিংফয়সাল'' এ্যাওয়ার্ড সে লাভ করে মানবতার সেবা করার জন্য। আল্লাহ্‌ তাকে অবশ্যই আখিরাতেও ফলদান ইনশাআল্লাহ্‌।''এ''- তার লক্ষ্য কি ''এপ্রোপ্রিয়েট" ছিল??? হ্যায় তার লক্ষ্য অবশ্যই যথোপযুক্ত ছিল। খ্রিষ্টান মিশনারি যারা মুসলমানদেরকে অত্যাচার নিপীড়ন করতো তাদের জন্য এটা একটা যথোপযুক্ত উত্তর ছিল। পাশাপাশি তার বাগ্মিতা হাজার হাজার তরুণকে অনুপ্রেরণা দান করেছিল।''এম''-তার লক্ষ্য কি ''মেজারেবল'' অর্থাৎ পরিমাপযোগ্য ছিল??? হ্যায় তার লক্ষ্য অবশ্যই পরিমাপযোগ্য ছিল। কারণ তিনি খ্রিষ্টান মিশনারিদের বইসমূহ সংগ্রহ করে সেগুলো অধ্যয়ন করে তবেই যথাযথ উত্তর দিয়েছিলেন। ''আই''- তার ''ইনটেনশন''কি সঠিক ছিল???? হ্যায় তার নিয়ত অবশ্যই সঠিক ছিল। তার নিয়ত ছিল আল্লাহ্‌ ও রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন।''সি''- লক্ষ্যের মধ্যে ধারাবাহিকতা অর্থাৎ ''কনসিসটেন্সি'' ছিল কি??? হ্যায় অবশ্যই তার লক্ষ্যের মধ্যে  ''কনসিসটেন্সি'' ছিল।উপরে যে দুটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে তার মধ্যে মূল পার্থক্য কোথায় বলতে পারেন??? মূল পার্থক্য হচ্ছে তাদের লক্ষ্যে। ''উইলমা রুডলফ্‌'' এর লক্ষ্য ছিল-এই দুনিয়ায় দৌড় প্রতিযোগিতায় সফলতা অর্জন যা সে পেয়েছে।শেখ আহামেদ দিদাদ এর লক্ষ্য ছিল- আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখিরাতের আযাব থেকে মুক্তি লাভ। দুনিয়াতে তিনি ১৯৮৬ সালে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ''কিং ফয়সাল'' এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। আখিরাতেও আল্লাহ্‌ তাকে পুরস্কৃত করবেন ইনশাআল্লাহ্‌।
যদি মহান আল্লাহ্‌ কাউকে এই দুনিয়ায় অর্থ সম্পদ দ্বারা পুরস্কৃত করেন তবে তার উপর নির্ভরশীল হওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আমরা নবী হযরত সুলায়মানের উদাহরণ দিতে পারি। তিনি যথেষ্ট সম্পদশালী ছিলেন কিন্তু তিনি তার উপর নির্ভরশীল ছিলেন না। তাই এটাকে আমরা ''মুবাহ্‌" বলতে পারি।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ(সা:) এর ক্ষমতা, খ্যাতি, ও রাজা হওয়ার সম্পূর্ণ যোগ্যতা ছিল। কিন্তু মহানবী (সাঃ) কখনই তা প্রয়োগ করেননি বা ক্ষমতার অহংকার করেননি।মহানবী(স:) যে সকল উপহার পেতেন তার বেশিরভাগই তিনি তার সাহাবীদের দিয়ে দিতেন।
সুতরাং সম্পদশালী হলে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করা অধিক বাঞ্ছনীয়। ব্যয় কুরআন ও সুন্নাহ্‌ মোতাবেক করা উচিৎ। কুরআন ও সুন্নাহ্‌র নির্দেশ সবসময় অনুসরণ করে চলতে হবে।তার অর্থ এই নয় যে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে অবহেলা করা। দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জনের পর তা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যবহার করতে হবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
হযরত মুহাম্মাদ(সা:) পৃথিবীর সর্বকালের সব মানুষের জন্য আদর্শ। জর্জ বারনাডশ বলেছেনঃ '' আমি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে পড়েছিলাম, আমার মনে হয়েছে তিনি একজন মানবতার রক্ষক''। থমাস কার্লাইল বলেনঃ '' ১ নম্বর হিরো হযরত মুহাম্মাদ (সা:)। লামা টিন ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ যিনি তুর্কিদের ইতিহাস লিখেছেন তিনি বলেনঃ''বিশাল কারণ, সীমিত প্রয়োজন , বিশাল ফলাফলের উপর ভিত্তি করে যদি একজন ব্যক্তিকে বিবেচনা করা হয় তবে সেই ব্যক্তিটি হবেন মুহাম্মাদ(সাঃ)।এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকার ৪র্থ সংস্করণে বলা হয়েছে-- '' এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সফলইসলামি ব্যক্তিত্ব হযরত মুহাম্মাদ(সা:)''।পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে---''নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহ্‌র রাসূলের চরিত্রে উত্তম (সুন্দর) আদর্শ রয়েছে, অবশ্য সেই ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও আখিরাতের দিনের আশা রাখে এবং আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করে''। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ(সা:) শুধুমাত্র ধর্মের ক্ষেত্রে নয় সামাজিক, রাজনৈতিক, সবখানে সফল নেতৃত্বের এক বাস্তব উদাহরণ। তিনি যেকোনো প্রকৃত মুমিনদার ব্যক্তির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।
এছাড়া পবিত্র কুরআনে এমন কিছু মহিলাদের উল্লেখ আছে যারা মহিলাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে। যেমনঃ হযরত ঈসা (আঃ) এর মাতা মরিয়ম, ফেরাউন এর স্ত্রী আছিয়া, হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ) এর প্রথম স্ত্রী খাদিজা, ও হযরত মুহাম্মাদ(সাঃ) এর প্রিয়তম কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ)।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) নিজে বলেনঃ ''আল্লাহ্‌ একজন দুর্বল বিশ্বাসীর চেয়ে সবল বিশ্বাসীকে অধিক ভালোবাসেন''
ডাঃ জাকির নায়েক নিজের পরিবর্তনের কথাই সকলের সামনে তুলে ধরেন। শৈশবে আমি তোতলা ছিলাম। আমি নিজেকে কখনও মহান মনে করি না তবে আমি একজনই। আমি নিজেকে আল্লাহ্‌র বান্দা মনে করি । এখন আল্লাহ্‌র রহমতে আমি ১০,০০০ দর্শকের সামনে কথা বলতে পারি। আর অমুসলিমদের সাথে তো কথা বলার সময় তো কখনই আটকাই না।আমি এখন নিজেকে শারীরিক ডাক্তারের চাইতে মনের ডাক্তার হিসেবে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করি। আমি এখন দীনের দাওয়াতের প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করি। আমার দর্শন হচ্ছে যা কিছু করবো তা হবে ''ইউনিক''। আমি যখন ডাক্তারি পড়তাম তখন চিন্তা করতাম অস্কার এ্যাওয়ার্ড,গ্র্যামি এ্যাওয়ার্ড এ মানুষ এতো খরচ করে কেননা এই খরচ যদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য করা হয় তবে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জায়গায় সফলতা পাবো মাসাল্লাহ্‌। তাই আমি চিন্তা করে পিস টিভি এর কাজ শুরু করি ও ''আই আর এফ" গঠন করি।

( পিস টিভি)




জীবনের লক্ষ্য

আসলে সাধারণভাবে আমাদের জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, সিভিল সার্ভিসে যাওয়া, ব্যবসায়ী হওয়া, বিজ্ঞানী হওয়া, অধ্যাপক হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো হলেই কি মানুষ হওয়া যায়?
যে ডাক্তার আরেকজন মানুষকে অজ্ঞান করে তার অজ্ঞাতসারে কিডনি অপারেশন করে বের করে বিক্রি করে দেয় তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যে ইঞ্জিনিয়ার পারসেনটেজের পর পারসেনটেজ নিয়ে এমন স্থাপনা গড়ে যা ধ্বংসের কারণ হয় তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যে সচিব নিজের দেশের স্বার্থকে বিক্রি করে দেয় তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যে ব্যবসায়ী ড্রাগস, মদ বিক্রি করে, মানুষের জীবন ধ্বংসকারী জিনিস বিক্রি করে তাকে কি মানুষ বলা যায়?





যে অভিনেতা-অভিনেত্রী মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বিজ্ঞাপনের মডেল হয় তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যে বিজ্ঞানী মানুষ হত্যার জন্যে মরণাস্ত্র তৈরি করে তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যে অধ্যাপকের হাতে তার ছাত্রীর সম্ভ্রম অনিশ্চিত থাকে তাকে কি মানুষ বলা যায়?
যদি বিদ্যা দ্বারা আমরা আলোকিত হতাম তাহলে জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত অনন্য মানুষ হওয়া যে, আমাকে মানুষ হতে হবে।
মানুষ হতে হলে তার লক্ষ্য হবে জৈবিক লালসা চরিতার্থ করা নয়, লক্ষ্য হবে সৃষ্টির সেবা করা। আর সৃষ্টির সেবার জন্যে প্রয়োজন হচ্ছে মেধার বিকাশ করা। আর পেশা হচ্ছে মেধাকে বিকশিত করার মাধ্যম। আমাকে আমার মেধাকে বিকশিত করতে হবে সৃষ্টিকে সর্বোত্তম সেবা করার জন্যে, জীবনের লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিৎ। আর অর্থ বিত্ত খ্যাতি সবই আসবে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে। কারণ সেবা প্রদান করলে প্রকৃতির নিয়মেই এগুলো প্রতিদান হিসেবে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন উপলক্ষ্যগুলোই আমাদের লক্ষ্য হয়ে গেছে।



(সংগৃহীত)

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি? - ২ : হুমায়ুন আজাদ


অন্যদের সমস্ত কিছুতে নাক গলাতে বাঙালি শুধু পছন্দই করে না, এটা কর্তব্য ব’লে গণ্য করে। বাঙালি তার এলাকার সকলের সমস্ত খবর রাখে, খারাপ খবরগুলো মুখস্ত রাখে; এবং যদি কারো কোনো খারাপ খবর না থাকে, তবে বাঙালি তার একটা খারাপ খবর তৈরি করে। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে বিশ্বাস করে না। বাঙালি অন্যের একান্ত বা ব্যক্তিগত কিছু সহ্য করে না। তাই বাঙালির কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। বাঙালি প্রতিবেশীর ঘরবাড়ির ওপর বিনিদ্র চোখ রাখে, ওই বাড়িতে কে বা কারা আসে, কখন আসে ও যায়, সব সংবাদ রাখে, এবং সংবাদ বানায়। বাঙালির ঘরবাড়িতে যে দরোজাজানালা লাগানোর ব্যবস্থা আছে, এটা আপত্তিকর ব্যাপার প্রতিবেশীর চোখে। বাঙালি কারো সাথে দেখা করতে এলে দরোজায় কড়া নাড়ে, ডাকে; সাড়া না পেলে পাড়া মাতিয়ে তোলে, এমনকি দরোজা ভেঙে ঘরে ঢোকার উপক্রম করে। বাঙালির চোখে ব্যক্তিগত জীবন পাপ; বাঙালি মনে করে দরোজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়; তাই তার দায়িত্ব অন্যের দরোজা ভেঙে ঢুকে তাকে পাপ থেকে উদ্ধার করা। তবে বাঙালি উদ্ধার করে না, অন্যকে বিপদে ফেলাই তার সমস্ত উদ্বেগের উদ্দেশ্য। বাঙালি অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানোর আরেকটি দিক হচ্ছে কুৎসা রটনা। বাঙালি কুৎসা রটিয়ে সুখ পায়; আর এ-কুৎসা যদি যৌন হয়, তাহলে তা সর্বশ্রেষ্ঠ। বাঙালি একটি নিন্দাকেই বড়ো নিন্দা মনে করে, তা হচ্ছে লাম্পট্য নিন্দা। কোনো পুরুষকে লম্পট অথবা কোনো নারীকে ভ্রষ্টা হিশেবে চিহ্নিত করে দিতে পারলে বাঙালি জীবন সার্থক হয়েছে ব’লে মনে করে। 

বাঙালির যৌনজীবন একটি ভয়ংকর ট্যাবো। ওই জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না; কিছু লেখা হয় না। ওটাকে নিষিদ্ধ জীবনও বলা যায়। এক আশ্চর্য সন্দেহজনক গোপনীয়তায় ঢাকা ওই জীবন, যেনো তার আলোচনা পাপ। এ থেকেই বোঝা যায় তার ওই জীবনটি পঙ্কিল, দূষিত, অপরাধপূর্ণ, অস্বাভাবিক ও সুখশূণ্য। বাঙালি যৌন ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী; প্রতিটি পুরুষ একেকটি ক্যাসানোভা, কিন্তু তাদের কামনা সাধারণত অচরিতার্থই থাকে, তাই ভরা থাকে নানা বিকৃতিতে। কিশোরেরা বাঙলায় জড়িত যৌনবিকৃতিতে, যুবকেরা সময় কাটায় যৌনক্ষুধায়, বয়স্ক ও বৃদ্ধরাও তাই। অধিকাংশ বাঙালিই যৌনআলোচনায় সুখ পায়, অন্যের যৌনজীবন নিয়ে কুৎসা রটায়; বড়োদের আলোচনার বড়ো অংশ যৌনতাবিষয়ক। কিন্তু পরিচ্ছন্ন ভন্ড তারা; তাদের কাছে এ-সম্পর্কিত কিছু জানতে গেলে তারা এমন ভাব করে যেনো তারা যৌনতার কথা কখনো শোনে নি; কাম কী তারা জানে না। বাঙালির জীবনের এ-অংশটি বিকৃত। বাঙালিসন্তান এ-বিষয়ে কোনো শিক্ষা পায় না; নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে জানে না; তাদের আচরণ ও ব্যবহার জানে না। পরোক্ষভাবে তারা কতোগুলো সামাজিক ও ধর্মীয় নিষেধের মুখোমুখি হয়। ওই নিষেধগুলো পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। বাঙালির যৌনজীবনে বিজ্ঞান নেই, কলাও নেই; রয়েছে পাশবিকতা। বাঙালির যৌবন অতিবাহিত হয় অবদমিত যৌন কামনাবাসনায়, যার ফল বিকৃতি। ধর্ষণ বাঙলায় প্রাত্যহিক ঘটনা, বাঙালিকে ধর্ষণকারী জাতিও বলা যায়। এর মূলে রয়েছে সুস্থ যৌনজীবনের অভাব। পশ্চিমে যে-বয়সে তরুণতরুণীরা ঘনিষ্ট হয়, সুখ আহরণ করে, সে-বয়সটা বাঙালির কাটে প্রচন্ড যন্ত্রণায়। বাঙালির যৌবনমাত্রই ব্যর্থ, ও যন্ত্রণাপীড়িত। সুস্থ মানুষ ধর্ষণ করে না; অসুস্থরা ধর্ষণ না করে পারে না। বাঙালির বিবাহবহির্ভূত যৌনজীবন ছোটো নয়, তারা খোঁজে থাকে এ-সুযুগের; কিন্তু বিবাহিত যৌনজীবনই তার শরীর কামনা পরিতৃপ্তির প্রধান স্থল। এ-ক্ষেত্রে বাঙালি কি তৃপ্ত? এ-সম্পর্কে কোনো সমীক্ষা পাওয়া যায় না; আলোচনা পাওয়া যায় না কোনো। বাঙালি এ-ক্ষেত্রে পরিতৃপ্ত নয়; শুধু অপরিতৃপ্তই নয়, প্রচন্ড অসুখী। বাঙালির যৌনক্ষেত্রে পুরুষ সক্রিয় কর্মী; নারী নিষ্ক্রিয় শয্যামাত্র। পুরুষ নিজের সাময়িক সুখ ছাড়া আর কিছু ভাবে না, সঙ্গিনীও যে সুখী হ’তে চায়, তা জানে না; কখনো জানার কথা ভাবে না। বাঙালি নারীপুরুষ পরিতৃপ্তির সাথে পরস্পরকে উপভোগ করে না। উপভোগের ধারণাও তাদের নেই। যে-প্রশান্তি, স্বাস্থ্য ও নিরুদ্বেগ পরিবেশ প্রয়োজন পরিতৃপ্তির জন্যে, তা নেই অধিকাংশ বাঙালির। তাই বাঙালি অনুপ্রাণিত হওয়ার সাথে সাথেই উপসংহারে পৌছে; এটা তার জীবনের সংক্ষিপ্ততম কাজ; যদিও এটা বৃহত্তম কাজ জীবনে। এখানে যে-অপরিতৃপ্তি, তা ঘিরে থাকে বাঙালি সমগ্র জীবন; তাকে রুগ্ন ক’রে রাখে। এ-রুগ্নতার ফল বাঙালির হঠাৎ-জাগা কামনা। বাঙালি নারী দেখলেই তাকে কাম্য বস্তু মনে করে, মনে মনে রমণ করে। এমন যৌনঅসুস্থ জাতি জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুস্থ হ’তে পারে না।

একটা রোগ আগে বাঙালির ছিলো না; কিন্তু গত দু-দশকে উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে ওই রোগটির, যার নাম ‘স্থানচ্যুতির অস্থিরতা বা বৈকাল্য’। বৃটিশ পর্বে বাঙালি জানতো সমাজে তার স্থান কোথায়, যে চাষী হবে, না হবে দারোগা, না কেরানি, না মেজিস্ট্রেট? পাকিস্থাপর্বেও জানতো কী হ’তে পারে সে; তার স্বপ্নের একটি নির্দিষ্ট সীমা ছিলো। দু-দশকে ওই সীমাটি ভেঙ্গে গেছে; বাঙালি এখন যা কিছু হতে পারে। যার স্বপ্ন সে দেখে নি, তা সে পেতে পারে; যার যোগ্যতা সে অর্জন করে নি, সে তার প্রভু হ’তে পারে। যার হওয়ার কথা ছিল বা যে সুখী বোধ করত নিম্নপদস্থ হয়ে, সে হঠাৎ একদিন নিজেকে দেখতে পাচ্ছে উচ্চপদে; যে-কেরানিও হতে পারতো না, সে মন্ত্রনালয়ের প্রভু হচ্ছে; যার কথা ছিলো অসরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো অধ্যাপক হচ্ছে। যার বাসে ঝোলার কথা ছিলো, সে হঠাৎ হয়ে উঠছে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ফলে চারিদিকে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। পদ আর ব্যক্তিটির মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি হচ্ছে না, পদটিকে মনে হচ্ছে ব্যক্তিটির ওপরে, বা ব্যক্তিটির মাথার ওপর চেপে আছে পদটি। চারপাশে এখন দেখা যাচ্ছে স্থানচ্যুতি রোগটি। তাই কোথাও কিছু চলছে না ঠিক মতো। চারিদিকে বিকলন।

পশ্রীকাতরতা, বলা যাক পরোন্নতিকাতরতা- কারণ কারোই শ্রী নেই এখন, বাঙালির একটি স্থায়ী রোগ। পিতামাতার জিনক্রোমোসোমের সাথে, ছেচল্লিশের দ্বিগুণ হয়ে, এটি সংক্রমিত হয় বাঙালির সত্তায়। কারো ভালো দেখতে নেই, এমন একটি জন্মলব্ধ জ্ঞান নিয়ে আসে বাঙালি; আর চারপাশে যা দেখে, তাতে উত্তেজিত থাকে সবসময়। তবে বাঙালি শত্রুর উন্নতিতে যতটা কাতর হয়, তারচেয়ে বেশি কাতর হয় বন্ধুর উন্নতিতে। উন্নতির ক্ষেত্রে বন্ধুই বাঙালির শত্রু। শত্রুর উন্নতি ঘটলে যে-বিষ ঢোকে বাঙালির শরীরে, তা মধুর করা যায় নিন্দা ক’রে; কিন্তু বন্ধুর উন্নতিতে রক্তনালি দিয়ে ছড়িয়ে পড়া বিষকে কিছুতেই মধুর করা যায় না। একটিই উপায় আছে , সেটি বন্ধুবিচ্ছেদ। উন্নতিকাতরতা রোগটি হয়তো জন্মসূত্রে পাওয়া নয় বাঙালির, পাওয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূত্রে, যে-সূত্র কোনো নিয়ম মানে না। যোগ্যের উন্নতি হয় না বাঙালি সমাজে, উন্নতি ঘটে অযোগ্যের; অযোগ্যরাই তাদের অসাধারণ যোগ্যতা দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যায়, যোগ্যরা নিচে প’ড়ে থাকে। উন্নতির সুযোগ এত সীমিত যে তা’কে ভাগ্য না বলে উপায় নেই, কে যে ভাগ্যবান হবে তা আগে থেকে বলা যায় না। কিছুই সুনিশ্চিত না বাঙালি সমাজে, সুনিশ্চিত শুধু অসংখ্য বাঙালির উন্নতিকাতরতা রোগে আক্রান্ত হওয়া। উন্নতির একটি উপায় এখানে দাসত্ব বা দালালি। বাঙালিসমাজ প্রধানত দালালসমাজ। পরোন্নিতিকাতরতা থেকে মুক্তির একটি উপায়ও বের করেছে বাঙালি, চমৎকার উপায়, তা হচ্ছে পরনিন্দা। বাঙালি পরনিন্দায় সুস্থবোধ করে। পরনিন্দা শুধু ছিদ্রান্বেষণ নয়, যার যে ছিদ্র নেই তার সে-ছিদ্র আবিষ্কারই পরনিন্দা। বাঙালি উপকারীর নিন্দার জন্যে খ্যাত। নিন্দিতরাও এর চমৎকার উত্তর বের করেছে, তারা যে-কোনো সমালোচনাকেই নিন্দা ব’লে গণ্য করে। বাঙালির দোষের শেষ নেই; তাই তার আচরণের বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ বর্ণনাকেও নিন্দা ব’লে মনে হয়। বাঙালি সমালোচনা সহ্য করে না, নিজেকে কখনো সংশোধন করে না; নিজের দোষত্রুটি সংশোধন না ক’রে সেগুলোকে বাড়ানোকেই বাঙালি মনে করে সমালোচনার যথাযথ উত্তর। বাঙালি যখন নিজের সম্পর্কে অন্য কারো মত চায়, তখন সে প্রশংসাই আশা করে; আর প্রশংসা না পেলে ক্ষুব্ধ হয়। বাঙালি নিজের সব কিছুকেই মনে করে প্রশংসনীয়; কিন্তু বাঙালি কখনো অন্যের প্রশংসা করে না। বাঙালি শক্তিমানের মিথ্যা প্রশংসা করে, যা স্তাবকতা মাত্র; কিন্তু প্রকৃতই প্রশংসা যার প্রাপ্য, তার কখনো প্রশংসা করে না। যার প্রশংসা প্রাপ্য, তার প্রশংসা করাকে বাঙালি গণ্য করে নিজের অপূরণীয় ক্ষতি ব’লে।

বাঙালি দায়িত্বহীন, কোনো দায়িত্বই বাঙালি ঠিকমতো পালন করে না। তবে বাঙালি দায়িত্ব পালন সম্পর্কে অন্যকে হিতোপদেশ দিতে ব্যগ্র থাকে। কোনো কাজের সাথে যদি নিজের স্বার্থ জড়িত না থাকে, তাহলে বাঙালি সেটি দিনের পর দিন ফেলে রাখে, এবং চাপ ছাড়া কোনো কাজ করে না। বাঙালির প্রতিটি কর্মস্থল অকর্মস্থল, দায়িত্ব-পালন-না করার কেন্দ্র। বাঙালি কর্মস্থলে ঠিকমতো যায় না, গেলেও কোনো কর্ম করে না; যা করে, তার অধিকাংশই অকর্ম। বাঙালির জীবনের অর্ধেকেরও বেশী ব্যয় হয় অকর্মে। বাঙালি সততার ভান করে, কিন্তু খুবই অসৎ। প্রতিটি কর্মক্ষেত্র অসৎ মানুষের লীলাভূমি। ঘুষ খাওয়া বাঙালির প্রিয়। বাঙালি সবসময়ই সুযোগে থাকে কীভাবে অন্যকে ফেলা যাবে অসুবিধায়, এবং ঘুষ খাওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। বাঙালির রাষ্ট্রব্যবস্থাই ঘুষ খাওয়ার যন্ত্র। ঘুষ খাওয়াকে বাঙালি গৌরব মনে করে। বাঙালি নীতির কথা বলে সব সময়, কিন্তু নীতি রক্ষা করে না। বাঙালি মনে করে নীতি রক্ষা করবে অন্যে, তার নিজের কাজ হচ্ছে নীতির কথা বলা। সামান্য অসুবিধার জন্যে বাঙালি প্রতিমার মতো নীতি বিসর্জন দেয়; কোনো অনুতাপ বোধ করে না।

বাঙালি ইন্দ্রিয়পরায়ণ, সব ধরণের নেশার প্রতি আসক্ত; কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করে না। সুযোগে সব বাঙালিই মদ্যপান করে, কিন্তু স্বীকার করে না। ধুমপান বাঙালির প্রিয় নেশা। অন্যান্য নেশা যেহেতু নিষিদ্ধ বাঙালি সমাজে, তাই ধুমপানকেই তারা নিজেদের সমস্ত উদ্বগ থেকে মুক্তির উপায়রূপে গণ্য করে। বাঙালির ধারণা মদ্যপান করলেই মাতাল হ’তে হয়, বা মাতাল হয়; তাই বাঙালি সামান্য পানের পরেই মাতলামো করে। বাঙালির জীবনে আনন্দ নেই, আনন্দ পাওয়াকে বাঙালি গর্হিত ব্যাপার মনে করে। আনন্দ পাওয়ার জন্যে দরকার উৎসব; কিন্তু বাঙালির উৎসবগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাঙালি সেগুলোতে অংশ নেয় না, থাকে দর্শকরূপে। আনন্দ পাওয়ার জন্যে নিজেকে ভুলে যাওয়াও দরকার, কিন্তু বাঙালি ভোলে না সে কে। বড়োই আত্মসচেতন বাঙালি। বাঙালি আত্মসচেতন, অর্থাৎ শ্রেনীসচেতন, পদসচেতন, অর্থসচেতন। বাঙালি সব সময় নিজের সঙ্গে অপরের তুলনামুলক মূল্যায়নে ব্যস্ত থাকে, নিজেকে ওপরে দেখে, এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। বিচ্ছিন্নতা আনন্দ বা সুখের বিরোধী। প্রতিটি বাঙালি কোনো ব্যক্তি নয়, সে একটি শ্রেণী, বা পদ বা টাকার বাক্স। বাঙালি বাহ্যিকভাবে চালাকচতুর, অনেক কিছু বোঝেও তাড়াতাড়ি, কিন্তু বেশি কিছু বোঝে না। একজন জাপানি বা চীনার পাশে বাঙালিকে মনে হবে অনেক বেশি চৌকশ, চীনা-জাপানিকে মনে হবে বোকা; তবে ঈশপের খরগোশের মতো বাঙালি মাঝপথে ঘুমিয়ে পড়বে; অন্যরা এগিয়ে যাবে কিংবদন্তির কাছিমের মতো। বাঙালি ‘মোটামুটি’তেই সন্তুষ্ট, তারা কখনো চরম উৎকর্ষের অভিলাষী নয়।

বাঙালি না ভেবে লাফ দেয়, এবং লাফ দেয়ার পর বার বার ভাবে, অর্থাৎ অনুশোচনা করে। প্রতিটি বাঙালির জীবন অসংখ্য অনুশোচনার ভান্ডার। বাঙালি যা হ’তে চায়, সাধারণত তা হয় না; এবং যা হয়, তা সাধারণত হ’তে চায় নি। তাই জীবন কাটে অনুশোচনায়। ধারাবাহিক অনুশোচনার শ্লথ স্রোত বাঙালির জীবন। বাঙালি নিজেদের মনে করে অন্য জাতিদের থেকে উৎকৃষ্ট;- অন্য সমস্ত জাতিকেই দেখে পরিহাসের চোখে, এবং নিজেদের সব কিছুকে মনে করে অন্যদের সবকিছুর চেয়ে ভালো। তাই বাঙালি জাতিগর্বী। তার চোখে চীনা-জাপানি হাস্যকর, পাঠানপাঞ্জাবি উপহাস্যকর; পশ্চিমের মানুষেরা প্রায় অমানুষ। তবে এদের মুখোমুখি বাঙালি অসহায় বোধ করে, ভোগে হীনমন্যতায়। বাঙালি ভিক্ষা করতে লজ্জা বোধ করে না। দরিদ্রদেরই শুধু নয়, বাঙালি ধনীস্বভাবের মধ্যেও রয়েছে ভিখিরির স্বভাব। বাঙালির স্বভাবের কোনো দৃঢ়তা নেই; তাই বাঙালির পতনও ট্র্যাজিক মহিমামন্ডিত হয় না, পরিণত হয় প্রহসনে। বাঙালি ভাঙে না, লতিয়ে পড়ে। বাঙালির প্রিয় দর্শন হচ্ছে বেশি বড়ো হোয়ো না ঝড়ে ভেঙে পড়বে, বেশি ছোটো হোয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে;- তাই বাঙালি হ’তে চায় ছাগলের সীমার থেকে একটু উচ্চ,- নিম্নমাঝারি। বাঙালির এ-প্রবচনটিতে তার জীবনদর্শন বিশুদ্ধরূপে ধরা পড়ে। এতে নিষেধ করা হয়েছে অতি-বড়ো হওয়াকে, কেননা তাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা; আর নিষেধ করা হয়েছে খুব ছোটো হওয়াকে, কেননা তাতে সহজেই বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা। তাই মাঝারি হ’তে চায় বাঙালি; বাঙালি মাঝারি হওয়ার সাধক। মাঝারি হতে চাইলে হওয়া সম্ভব নিম্নমাঝারি; এবং বাঙালির সব কিছুতেই পরিচয় পাওয়া যায় নিম্নমাঝারিত্বের।

বাঙালি উদ্ভাবক নয়, তাত্ত্বিকও নয়। সম্ভবত কোন কিছুই উদ্ভাবন করে নি বাঙালি, এবং বিশ্বের আধূনিক উদ্ভাবনগুলোতে বাঙালির কোনো ভূমিকা নেই। কোনো তত্ত্ব ও চিন্তার জনক নয় বাঙালি; বাঙালির সমস্ত তত্ত্বই ঋণ করা। আধূনিক বাঙালির জীবনে যে-সমস্ত তত্ত্ব কাজ করে, তার একশোভাগই ঋণ করা। বাঙালি সাধারণ সূত্র রচনা করতে পারে না, আন্তর শৃঙ্খলা উদ্ঘাটন করতে পারে না; পারে শুধু বর্ণনা করতে। বাঙালি সংঘ গরে তুলতে পারে না, তবে ভাঙতে পারে; এক সংঘকে অল্প সময়ের মধ্যে বহু সংঘে বিশ্লিষ্ট করার প্রতিভা রয়েছে বাঙালির। বাঙালি একদিন যা গ’ড়ে তোলে কিছুদিন পর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তাতেই। বাঙালি যে-সংঘের প্রধান হ’তে পারে না, সে-সংঘ তার নিজের গড়া হ’লেও তাকে সে আর প্রয়োজনীয় মনে করে না। বাঙালি আমরণপ্রাধান্যে বিশ্বাস করে। তাই বাঙালি গণতান্ত্রিক নয়, যদিও গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দেয়। বাঙালি সুবিধাবাদী; সুবিধার জন্যে সব করতে পারে। বাঙালি পুজো করতে পছন্দ করে; প্রতিমা বা লাশ পুজোতেই বাঙালির সুখ। বাঙালি লাশের গলায় মালা দেয়, তবে জীবিতকে লাশে পরিণত করে। বাঙালি মূল্যায়ন করতে পারে না; কারো বা কোনো বস্তুর আন্তর মূল্য কতোটা, তা স্থির করতে পারে না বাঙালি; একবার কারো বা কিছুর ভুল মূল্য স্থির হয়ে গেলে, তার পুনর্মূল্যায়নে বাঙালি রাজি হয় না।

এমন একটি জনগোষ্ঠিকে কি রুগ্ন বলে শনাক্ত করা ছাড়া আর কোনো পথ আছে? এ-রুগ্নতা সাময়িক নয়, কয়েক দশকের নয়, বহু শতকের; সম্ভবত শুরু থেকেই বাঙালি ভুগছে এ-সমস্ত রোগে; এবং দশকে দশকে দেখা দিচ্ছে নানা অভিনব ব্যাধি। তার শরীর রুগ্ন, রুগ্ন তার মন; তার আচরণ রুগ্ন, রুগ্ন তার স্বপ্ন। তার সমাজ রুগ্ন, সামাজিক রীতি রুগ্ন; তার রাজনীতি রুগ্ন, রুগ্ন তার রাষ্ট্র। কোথাও তার স্বাস্থ্য নেই, সুস্থতা নেই। এতো রোগের সমষ্টি যে-জনগোষ্ঠি, তার বর্তমান অবশ্যই শুয়ে আছে রোগশয্যায়; তার ভবিষ্যত শুধু শ্মশান বা কবরস্থান। বাঙালি ভবিষ্যতে টিকে থাকবে কিনা, সন্দেহ করা চলে। মালার্মে অনেক আগেই মুমূর্ষ বা অবলুপ্তির কাছাকাছি পৌছে যাওয়া একটি পাখির সাথে তুলনা করেছিলেন বাঙালিকে; ফরাশি প্রতীকী কবির এ তুলনাটি যদি সত্যে পরিণত হয়, তাহলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। বাঙালি চিকিৎসায় বিশ্বাসী নয়। কোনো দিকেই বাঙালির রোগের চিকিৎসা চলছে না। জাতির চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু রাষ্ট্র চিকিৎসার বদলে রোগ বাড়াতেই বেশি আগ্রহী। রাষ্ট্র এখন রুগ্ন ক’রে চলেছে বাঙালির শরীর ও মন, তার কাঠামো ও মনোজগত; রুগ্ন করে চলেছে তার সমাজ, রাজিনীতি, রাষ্ট্র। রুগ্ন রাজনীতি বিনাশ ঘটায় সব কিছুর; এখন বিনাশ ঘটছে বাঙালির সব কিছু। বাঙালি হয়ে উঠছে আরো প্রতারক, ভন্ড; হয়ে উঠছে আরো অসৎ, নীতিশূণ্য, আদর্শহীন; বাঙালি হয়ে উঠছে আরো খল, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী। নিয়ন্ত্রণের ফলে বিকৃত হচ্ছে বাঙালির শরীর, ও কামনাবাসনা। যতোই ধর্মের কথা বলা হচ্ছে অজস্র মাইক্রোফোনে, ততোই বাড়ছে অনৈতিকতা; যতোই শোনানো হচ্ছে সংযমের কথা, ততোই বাড়ছে অসংযম ও বিকৃত কাম; পান যতোই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, শক্তিমান মাতালের সংখ্যা ততোই বাড়ছে। বাঙালি হয়ে উঠছে একটি বিকৃত জনগোষ্ঠি। মনোবিজ্ঞানীর চোখ দেয়া দরকার এদিকে, যেমন চোখ দেয়া দরকার সমাজবিজ্ঞানীর। বাঙালির রুগ্নতা আর লুকিয়ে রাখা চলে না, ক্ষতস্থলকে ময়লা কাপড়ে মুড়ে রাখলে ক্ষত শুকোয় না, তাতে পচন ধরে। পচন ধরেছে এর মাঝেই। বাঙালির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না;- একটি জনগোষ্ঠি কি রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হ’তে হ’তে লুপ্ত হয়ে যাবে?
হুমায়ুন আজাদ

বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি? - ১ : হুমায়ুন আজাদ

বাঙালি : একটি রুগ্ন জনগোষ্ঠি? - ১ : হুমায়ুন আজাদ 

Wednesday, 11 January 2012 at 19:3

বাঙালি, পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। তার দেশ ছোটো;- ছোটো ভূভাগে বাস করার একটি ফল মানসিকভাবে ছোটো, সংকীর্ণ হওয়া; কুপমন্ডুকতায় ভোগা, যাতে ভুগছে বাঙালি অনেক শতাব্দী ধ'রে। বাঙালির এক অংশ প'ড়ে আছে এক বড়ো দেশের একপ্রান্তে, ভুগছে প্রান্তিক মানসিকতায়; এবং আরেক অংশ ঠাসাঠাসি করে বেঁচে আছে আরেক ভূভাগে, যা এক টুকরো। বাঙালির দারিদ্র বিশশতকের এক কিংবদন্তি ও সত্য। আর্থিক দারিদ্র মানুষকে মানসিকভাবে গরিব করে, বাঙালির মনের পরিচয় নিলে তা বোঝা যায়। প্রতিটি বাঙালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড়ো ভাবার অচিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙালি। ইতিহাসে বাঙালির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা গৌরবজনক নয়; এবং এখন যে পরিচয় পাই বাঙালির তা আরো অগৌরবের। প্রতিটি জনগোষ্ঠির রয়েছে একটি বিশেষ চরিত্র, যা দিয়ে তাকে শনাক্ত করা যায়; কিন্তু বাঙালির পাওয়া যায় না এমন কোন বৈশিষ্ট্য;- কোনো জাতি সরল, কোনো জাতি পরোপকারী, কোনো জনগোষ্ঠি উদার, বা মহৎ, বা আন্তরিক; বা কোনো জাতি স্বল্পভাষী, বা বিনয়ী, বা পরিশ্রমী, বা উচ্চাভিলাষী; কিন্তু বাঙালির নেই এমন কোনো গুণ, যার সংস্পর্শে এসে মুনষত্বের প্রসার ঘটতে পারে। বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ ও বিচার করা হয়েছে কি না, তা জানি না আমি; কিন্তু বোধ করি তা এখন জরুরি। বাঙালিকে এখন বিচার করা দরকার শারীরিক দিক থেকে- তার অবয়বসংস্থান কেমন, ওই সংস্থান মানুষকে কতোটা সুন্দর বা অসুন্দর করে, তা দেখা দরকার। বিচার করা প্রয়োজন বাঙালিকে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে;- কেমন তার মানসগঠন, ওই মনে নিয়ত চলছে কিসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া; দিনভর কতোটা ইর্ষায় ভুগছে, উত্তেজিত থাকছে কতোখানি, কতোটা গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে দিনরাত, বা কতোটা গৌরবে তার সময় কাটে। মানসিক এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু বাঙালির মানস উদ্ঘাটনের চেষ্টা হয়নি আজো। বাঙালির আচরণও বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও বিচারের বিষয়। বাঙালি সাধারণত কী আচরণ করে, তার সামাজিক আচরণ কেমন; বন্ধুকে কতোটা প্রীতির সাথে গ্রহণ করে, শত্রুকে দেখে কতোটা ঘৃণার চোখে; কতোটা কথা বলে বাঙালি, কথায় কতোটা বক্তব্য থাকে বা থাকে না, এবং আরো অনেক আচরণ সূক্ষভাবে বিচার করা দরকার। তার আর্থ, সামাজিক, রাজনীতিক জীবন ও আচরণ তো গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাই খুব বিস্তৃতভাবে রচনা করা দরকার বর্তমান বাঙালির জীবন ও স্বপ্নের ব্যাকরণ, যাতে আমরা বুঝতে পারি তার সমস্ত সূত্র। ওই সব সূত্র যদি কখনো রচিত হয়, তবে কি ধরা পড়বে যে বাঙালি একটি সুস্থ জনগোষ্ঠি, না কি ধরা পড়বে বাঙালি জাতি হিশেবে রুগ্ন; আর এ রুগ্নতা শুধু সাম্প্রতিক নয়, ঐতিহাসিকও। বাঙালির অহমিকা কি বাঙালিকে বাধা দেবে না নিজের নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে ও বিচারে? তা দেবে; কেননা বাঙালি সত্যের থেকে শূণ্য স্তাবকতা পছন্দ করে। আমি এখানে বাঙালির কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা বা বর্ণনা করতে চাই, বস্তুনিষ্ঠভাবে, যাতে বাঙালির ব্যাকরণ রচনার সূচনা ঘটে।

বাঙালির ভাষিক আচরণ দিয়েই শুরু করি। জাতি হিশেবে বাঙালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকন্ঠে, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয়টি বিতর্কিত হয়, পক্ষ-বিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচন্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে-কোন আলোচনায় বাঙালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙালির যুক্তি কন্ঠের উচ্চতা; যার কন্ঠ যত উঁচু সে নিজেকে ততোটা যুক্তিপরায়ণ ব'লে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত ব'লে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙালি কখনো পরাজিত হয়নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না। বাঙালি কথায় সাধারণত ভুল শব্দ ব্যবহার করে, বাক্য সম্পুর্ন করে না; এক কথা বলে অন্য কথা বুঝিয়ে থাকে। বাঙালি উচ্চকন্ঠে আলাপ করে, অযুক্তি পেশ করে, এবং অনেকের মাঝখানে থেকেও ফিশফিশে স্বরে চমৎকার চক্রান্ত করতে পারে। বাঙালি কারো সাথে দেখা হ'লেই কথা বলে, কথার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও। বাঙালি প্রচুর মিথ্যা কথা বলে থাকে, অনেকে মিথ্যা কথা বলাকে মনে করে চাতুর্য, একধরণের উৎকর্ষ। বাঙালির প্রতিটি এলাকায় অন্তত একজন পেশাদার মিথ্যাবাদী পাওয়া যায়। দক্ষিণ ভারতে একটি উপজাতি রয়েছে, যারা চল্লিশ বছর পার হওয়ার পর কথা বলাই থামিয়ে দেয়, তাদের বলার মতো আর কিছু থাকে না। বাঙালি এর বিপরীত- বয়স বাড়ার সাথে কথাও বাড়তে থাকে বাঙালির; বাঙালি বুড়োরা কথা বলার জন্য প্রসিদ্ধ। বাঙালির কথার পরিমাণ ও বক্তব্য সমানুপাতিক নয়; প্রচুর কথায় বাঙালি সামান্য বক্তব্য প্রকাশ করে। বাঙালির কথার প্রাচুর্য হয়ত বোঝায় যে জীবন তাকে ক্লান্ত করে নি; এবং সাথে সাথে এও বোঝায় যে জীবনে তার অপ্রাপ্তী অশেষ। বাঙালির অধিকাংশ কথা তার না পাওয়ার কথা, তার সমস্যার কথা, তার জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যর্থতার কথা। বাঙালি তার কথা দিয়ে জীবনে না-পাওয়ার শূণ্যতাগুলো পূরণ করে। এ-দিক দিয়ে বেশ ট্র্যাজিক জাতি বাঙালি; কিন্তু সে তার ট্র্যাজেডিকে লুকিয়ে রাখতে চায় অন্যের কাছে। বাঙালির কথায় ধরা পড়ে তার অন্তঃসারশূণ্যতাও।

বাঙালি গুছিয়ে কথা বলে না; এক কথা বারবার বলে; কথায় কথায় অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করে। সাধারণ মানুষের বাক্যের ভান্ডার বেশ সীমাবদ্ধ; কিন্তু তারা ওই সীমাবদ্ধ ভান্ডারকে বারবার ব্যবহার করে প্রায় অসীম ক'রে তোলে। বাঙালি মনে করে এক কথা বারবার বললে তা গ্রহণযোগ্য হয়, তাতে ফল ফলে। এটা হয়তো মিথ্যে নয়, কিন্তু এতে কথার তাৎপর্য কমে, মূল্য বাড়ে পৌনপুনিকতার। সাধারণ মানুষকে যদি ছেড়ে দিই, ধরি যদি মঞ্চের মানুষদের, বিচিত্র কথা বলা যাদের পেশা, তারাও একই কথা বারবার বলে। বাঙালি নতুনত্ব চায় না, বিশাস করে পুনরাবৃত্তিতে। পুনরাবৃত্তিতে বাঙালির প্রতিভা কি তুলনাহীন? বাঙালির স্বভাবে রয়েছে অতিশয়োক্তি, সে কোনো আবেগ ও সত্য প্রকাশ করতে পারে না অতিশয়োক্তি ছাড়া। অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে, যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। 'দারুণ পছন্দ করি', 'ভীষণ ভালোবাসি', 'শ্রেষ্ঠতম কবির' মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ। অতিশয়োক্তি লঘুতার লক্ষণ, এতে প্রকাশ পায় পরিমাপবোধের অভাব। বাঙালি লঘু, পরিমাপবোধহীন। বাঙালি সাধারণত কারো আন্তর গুরুত্ব নিজে উপলব্ধি করতে পারে না; অন্য কারো কাছ থেকে তার জানতে হয় এটা; এবং একবার অন্যের কাছ থেকে জেনে গেলে, বিচার না ক'রে, সে তাতে বিশ্বাস করে। বাঙালি ভাষাকে এক ধরণের অস্ত্ররূপেও ব্যবহার করে। কলহে বাঙালির প্রধান অস্ত্র ভাষা- আগ্নেয়াস্ত্রের মতো বাঙালি ভাষা প্রয়োগ ক'রে থাকে।

বাঙালি স্বভাবত ভদ্র নয়। সুবিধা আদায়ের সময় বাঙালি অনুনয় বিনয়ের শেষ সীমায় যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত অন্যদের সাথে ভদ্র আচরণ করে না। বাঙালি প্রতিটি অচেনা মানুষকে মনে করে নিজের থেকে ছোটো, আগন্তুক মাত্রকেই মনে করে ভিখিরি। কেউ এলে বাঙালি প্রশ্ন করে 'কী চাই?' অপেক্ষা করার জন্য বলে 'দাঁড়ান'। কোন কর্মক্ষত্রে গেলে বাঙালির অভদ্রতার পরিচয় চমৎকারভাবে পাওয়া যায়। যিনি কোনো আসনে ব'সে আছেন কোনো কর্মস্থলে, তাঁর কাছে অচেনা মানুষ গেলে তিনি সুব্যবহার পাবেন না, এটা বাঙালি সমাজে নিশ্চিত। আসীন কর্মকর্তা, তিনি যতো নিম্নস্তরেই থাকুন-না-কেনো, তিনি আগন্তুকের দিকে মুখ তুলেও তাকাবেন না; তাকালে মুখটি দেখে নিয়েই নানা অকাজে মন দেবেন। তিনি হয়তো পান খাবেন, অপ্রয়োজনে টেলিফোন করবেন, পাশের টেবিলের কাউকে ডেকে বাজে কথা বলবেন, আগন্তুকের দিকে মনোযোগ দেবেন না। সামনে কোনো আসন থাকলেও আগন্তুককে বসতে বলবেন না। বাঙালি অন্যকে অপমান ক'রে নিজেকে সম্মানিত করে। পশ্চিমে এটা কখনো হয় না। পশ্চিমে সাক্ষাৎপ্রার্থী সাদরে গৃহীত হয়, সম্মানিত হয়; কিন্তু বাঙলায় প্রতিটি সাক্ষাৎপ্রার্থী হয় অপমানিত। বাঙলায় সম্মানলাভের বড়ো উপায় হচ্ছে ক্ষমতা। কোথাও গিয়ে তাই প্রথমেই নিজের পদের পরিচয় দিতে হয়, ঐ পদটি যদি আসীন ব্যক্তিকে সন্ত্রস্ত করে, তাহলে সাক্ষাৎপ্রার্থী যথেষ্ট সমাদর লাভ করেন। তাই বাঙালি সামাজিকভাবে ভদ্র ও সৌজন্যপরায়ণ নয়; তার সৌজন্য ভীতি বা স্বার্থচেতনাপ্রসূত। বাঙালি যখন পথেঘাটে পরস্পরের মুখোমুখি হয়, তখনও ঠিক সৌজন্য বিনিময় ঘটে না। ধর্মীয় সম্বোধন অনেকে পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক'রে থাকে, তবে তা যতোটা যান্ত্রিক, ততোটা সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নয়। পশ্চিমে রাস্তায় বেরিয়েই পরিচিতজনের, সামান্য পরিচিতের, হাসিমুখ দেখা স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এখানে হাসিমুখ দুর্লভ; রেশারেশি বাঙলায় আলোবাতাসের মতো সত্য। প্রতিটি এলাকা পারস্পরিক রেশারেশিতে গোপন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ভয়ঙ্কর এখানে। তাই সামাজিক ভদ্রতা দুষ্প্রাপ্য। বাঙালি সমাজ প্রতি মুহূর্তে ক্ষমতানিয়ন্ত্রিত; প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি ক্ষমতারূপে বিরাজ করে, চলাফেরা করে। ক্ষমতা কোনো ভদ্রতা জানে না। ক্ষমতার দুটি দিকে রয়েছে;- একটি দম্ভ, তা শক্তিমানকে দাম্ভিক করে; আরেকটি অসহায়ত্ব, তা অধীন ব্যক্তিকে স্তাবকে পরিণত করে। তাই বাঙালি দাম্ভিক বা স্তাবক, ভদ্র নয়।

বাঙালির চরিত্রের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য ভন্ডামো। বাঙালি প্রকাশ্যে একটি মুখোশ পরতে ভালোবাসে, মুখোশটি নানা রঙে রঙিন ক'রে রাখে; কিন্তু তার ভেতরের মুখটি কালো, কুৎসিত। বাইরে বাঙালি সব আদর্শের সমষ্টি, ভেতরে আদর্শহীন। বাঙালি সততার কথা নিরন্তর বলে, কিন্তু জীবনযাপন করে অসততায়। বাঙলায় এমন কোনো পিতা পাওয়া যাবে না, যিনি পুত্রকে সৎ হ'তে বলেন না; আর এমন পিতাও খুব কম পাওয়া যাবে, যিনি পুত্রের অসৎ উপার্জনে গৌরব বোধ করেন না। 'চরিত্র' সম্পর্কে বাঙালির ধারণাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 'চরিত্রহীন' বলতে বাঙালি বোঝে পরনারীতে আসক্ত পুরুষ; তার চোখে আর কেউ চরিত্রহীন নয়, শুধু পরনারীআসক্তই চরিত্রহীন বা দুশ্চরিত্র। ঘুষ খাওয়া চরিত্রহীনতা নয়, গৌরব; কপটতা চরিত্রহীনতা নয়, মিথ্যাচার চরিত্রহীনতা নয়, এমনকি খুন করাও চরিত্রহীনের লক্ষণ নয়, শুধু নারীআসক্তিই চরিত্রহীনতা। তবে বাঙালি মাত্রই পরনারীআসক্ত; প্রকাশ্যে নয়, গোপনে। বাঙালি ধর্মের কথা সোরগোল ক'রে ব'লে ধর্মবিরোধী কাজ করে অবলীলায়, প্রগতির কথা ব'লে প্রগতিবিরোধী কাজ করে প্রতিদিন; বাঙালি প্রকাশ্যে মহত্ত্ব দেখিয়ে বাস্তবে কাজের সময় পরিচয় দেয় ক্ষুদ্রতার। বাঙালি যা বিশ্বাস করে মুখে তা প্রকাশ করে না; বাঙালি যা প্রকাশ করে আচরণে তা পালন করে না; বাঙালি পেছনে যার নিন্দা করে, মুখোমুখি তার তোষামোদ করে- যদি সে শক্তিমান হয়। শক্তি বাঙালির জীবনের বড়ো নিয়ন্ত্রক;- বাঙালি শক্তিমানের পদানত হয় নির্দ্বিধায়, আর দুর্বলকে পীড়ন করে অবলীলায়। বাঙালি শক্তিমানের কোনো ত্রুটি দেখে না, শক্তিমানের সমস্ত অন্যায়কে মেনে নেয়, বাঙালির চোখে শক্তিমান কখনো চরিত্রহীন নয়, শক্তিমানের কোন চরিত্র থাকার দরকার আছে বলেও মনে করে না বাঙালি; কিন্তু চরিত্রবান হওয়া দুর্বলের জন্য বিধিবদ্ধ। বাঙালি খুবই পরনিন্দা করে, পিতার নিন্দা করতেও কুন্ঠিত হয় না; তবে বাঙালির চোখে সামাজিকভাবে কেউ নিন্দিত নয়, যদি সে শক্তিমান হয়। নিন্দিত শক্তিমানের কন্ঠে মালা পরাতে বাঙালি লজ্জিত হয় না, গর্ব বোধ করে; নিন্দিত শক্তিমানকে নিমন্ত্রণ করে ধন্য বোধ করে বাঙালি। বাঙালি, অশেষ ভন্ডামোর সমষ্টি, শক্তিকেই মনে করে বিধাতা।

বাঙালির শরীরটির দিকেই তাকানো যাক একবার। বাঙালি কি সুন্দর, বাঙালি কি নিজেকে মনে করে রূপমন্ডিত? বাঙালির অহমিকা আছে, তাই নিজেকে রূপের আঁধার মনে করে নিশ্চয়ই; কিন্তু বাঙালির চোখে সৌন্দর্যের দেবতা অন্যরা। একটু ফরশা হ'লে বাঙালি তাকে বলে 'সাহেবের মতো সুন্দর'; একটু বড়োসড়ো হলে বাঙালি তার তুলনা করে, বা কিছুদিন আগেও তুলনা করত, পাঠানের সাথে। বাঙালি সাধারণত খর্বকায়, তবে সবাই খর্ব নয়; বাঙালির রঙ ময়লা, তবে সবাই ময়লা নয়, কেউ কেউ ফরশা। শাদা রঙটিকে পূজো করে বাঙালি, সম্ভবত সমস্ত ভারতবর্ষীয়ই। এদিক দিয়ে বাঙালিকে বর্ণান্ধ বা বর্ণবাদীও বলা যায়। রঙের জন্য এত মোহ আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। যে-মেয়ে শুধুই শাদা, আর কিছু নয়, যার মুখের দিকে তাকানো যায় না, যার শরীর বেঢপ, তাকেও বাঙালি সুন্দর বলে, কারণ সে শাদা। বাঙালি কালো, কিন্তু তার সৌন্দর্যের দেবী শাদা। বাঙালির শরীর সুন্দর নয়। কেউ হয়তো খর্ব, মধ্যভাগে মাংশ প্রচুর; নারীদের সৌন্দর্য কম, যদিও কেউ কেউ রূপসী। বাঙালি নারী বক্র হয়ে যায় পিঠ বাঁকিয়ে চলতে চলতে, আর ঠিক মতো সোজা হ'তে পারে না, সব সময় ঢাকা থাকে জড়তায়। বাঙালি পুরুষের কাঠামোতে পৌরুষের অভাব; নারীদের অভাব আবেদনের। বাঙালি অবশ্য নিজের সম্পর্কে সবকিছু বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে ব'লে সৌন্দর্যের কথাও বাড়িয়ে ব'লে থাকে; কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সাথে তুলনা করলে তার সৌন্দর্য স্থান পাবে তালিকার নিচের দিকেই। তাই বাঙালি তাকেই সুন্দর বলে যে দেখতে বাঙালির মতো নয়। তাহলে কি বাঙালির সৌন্দর্যচেতনা চিরকালই থেকে যায় অপরিতৃপ্ত? বাঙালির জীবন ভ'রে অপরিতৃপ্ত ও অসন্তোষ; অর্থ তাকে সচ্ছলতা দেয় না, সমাজ তাকে শান্তি দেয় না, রাজনীতি তাকে মানুষ হিশেবে গণ্য করে না, আর তার সৌন্দর্যপিপাসাও তাকে করে রাখে অপরিতৃপ্ত?

বাঙালি দরিদ্র কিন্তু অপচয়প্রবণ; আর বাঙালি সময়ের মূল্যবোধহীন। দারিদ্রের একটা বৈশিষ্ট্য সম্ভবত অপচয়, বা অপচয়ে তারা গৌরব বোধ করে। গরিব বাঙালির বাড়িতে গেলেও নানা অপচয় চোখে পড়ে। ভাতের অভাব বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক সত্য ও নিয়তি; কিন্তু প্রতি বাড়িতেই প্রতিদিন কিছু পরিমাণ হ’লেও ভাতের অপচয় ঘটে। কেউ হয়তো খাওয়ার সময় কিছু ভাত ফেলে দেয়, কেউ না-খেয়েই উঠে যায়; কিন্তু ধনী দেশগুলোতে এক টুকরো রুটিও অপচয় হয় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঙালির অপচয়ের কোনো শেষ নেই, এটা ব্যাক্তির অপচয়েরই রাষ্ট্রীয় পরিণতি। বাঙালির রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন অপচয় করে চলে, কিন্তু জাপানে একটি ইয়েনেরও অপচয় ঘটে না। অপব্যয় বাঙালির স্বভাব ও সামাজিক দাবি। বৃটেনে কারো আয়ের একটি ছোটো মুদ্রাও অপব্যয়িত হয় না; তারা নিজেরা অপব্যয় করে না, রাষ্ট্র অপব্যয় করতে দেয় না, সমাজ অপব্যয় করতে দেয় না। সিগারেটকেই উদাহরণ হিশেবে নিই। আমি সিগারেট খাই, হিশেব মতো খেতে চাই, কিন্তু হয়ে ওঠে না। পাশের কাউকে-না-কাউকে প্রতিদিনই দু-চারটি দিতে হয়, যদিও তাদের অনেকেই ধূমপায়ী নন, কিন্তু অন্যকে সিগারেট খেতে দেখলে ধূমপানের শখ জেগে ওঠে তাঁদের। প্রতিদিনই কয়েকটি সিগারেট অপচয় হয় আমার, যেমন হয় অধিকাংশ বাঙালির। আয় খুব সামান্য, কিন্তু অপচয় অনেক;- কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়ে। দর্জির কাছে কখনো একবার গিয়ে জামা তৈরি পাওয়া যায় না, দু-তিনবার যেতে হয়, অপচয় ঘটে সময়ের ও অর্থের; যে কাজে একবারের বেশি যাওয়ার কথা নয়, সেখানে যেতে হয় বারবার। এমন অপচয় পশ্চিমে ঘটে না। তারা অনেক আয় করেন, কিন্তু তাঁদের একটি সিগারেটেরও অপচয় ঘটে না। বাঙালি আয় করে কম, কিন্তু তার একটা বড় অংশ অপচয় হয়ে যায়। অপচয় হয় বাঙালির জীবন। বাঙালির সময় বোধ নেই বললেই চলে; বাঙালি পাঁচটা বললে ছটা-সাতটাও বোঝাতে পারে। সময় মতো যে চলে বাঙালি সমাজে সে-বেমানান, তাকে বার বার পড়তে হয় অসুবিধায়। বাঙালি সভা বা বৈঠক করতে খুবই উৎসাহী; প্রতিটি অফিস বৈঠকপরায়ণ, তারা প্রতিদিন নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে ব্যগ্র; কিন্তু ঠিক সময়ে কোনো সদস্য আসে না বৈঠকে। যারা আগে আসে তাদের মূল্য কম, বাঙালি মনে করে সময়বোধহীন বিলম্বীরাই মূল্যবান। যে-ঠিক সময়ে এসেছে বাঙালি তাকে খেয়াল করে না; কিন্তু যে আসে নি, আসবে কি না সন্দেহ, বাঙালি তার কথা বারবার বলে, তার জন্যে বড়ো আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

প্রতারণা বা প্রবঞ্চনা বা কথা না রাখায় বাঙালি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে। কারো সাথে আর্থিক সম্পর্কে জড়িত হ’লে প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে একশো ভাগ, না হ’লেই বিস্ময় জাগে। বাঙালি প্রচুর দলিলপত্র ক’রে ব্যবসায়ে নামে অন্যের সাথে, তারা সবাই সুযুগ খুঁজতে থাকে পরস্পরকে ঠকানোর, এবং ঠকাতে পারলে গৌরব বোধ করে, ও না ঠকলে অবাক হয়। ঋণ শোধ না করা বাঙালির স্বভাব। কেউ একবার ঋণ নিলে তা যে ফেরত পাওয়া যাবে, এমন আশা করা বাঙালি সমাজে অন্যায়; আর ফেরত পাওয়া গেলেও তা কখনো ঠিক সময়ে পাওয়া যায় না। বাঙালি কারো প্রাপ্য অর্থ শোধ করতেও কয়েকবার ঘোরায়। প্রথমে একটি তারিখ দেয়, প্রাপক গিয়ে দেখে অন্যজন অনুপস্থিত। তখন তার খোঁজ করতে হয়, পাওয়া গেলে প্রাপ্য টাকা পাওয়া যায় না, টাকা শোধের আরেকটি তারিখ পাওয়া যায়। অনেকবার ঘোরানোর পর বাঙালি টাকার কিছুটা শোধ করে, বাকিটার জন্যে আরেকটি তারিখ দেয়। এটাই হচ্ছে বাঙালির ঋণনীতি। ব্যবসাবাণিজ্যে যারা জড়িত, তারা প্রত্যেকেই প্রতারক; কাউকে-না-কাউকে প্রতারণ করে তারা টাকা করে। এখন অবশ্য রাষ্ট্রকে প্রতারণ করার পথই তারা আবিষ্কার করেছে। বাঙালি বন্ধুকে, পরিচিত জনকে, এমনকি অপরিচিতকেও নানা রকম কথা দেয়; কিন্তু কথা রাখে না। কথা না-রাখার অজুহাত বের করতে দক্ষ বাঙালি; এতো দক্ষ যে বাঙালির কথা শুনে যে বিশ্বাস করবে না তাকে চরম অবিশ্বাসী ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

বাঙালি খুবই স্বৈরাচারী; দেখতে এতোটুকু, কিন্তু সবাই ছোটোখাটো চেঙ্গিশ খাঁ। প্রতিটি পরিবারকে যদি একটি ছোটো রাষ্ট্র হিশেবে দেখি, তাহলে ঐ রাষ্ট্রের একনায়ক পিতাটি। পল্লীসমাজে পিতার একনায়কত্ব খুবই প্রবল ও প্রচন্ড; শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে কিছুটা কম। পিতার শাসনে স্বৈরাচারে পরিবারটি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে সারাক্ষণ; মা-টি হয় সবচেয়ে পীড়িত ও পর্যুদস্ত, সন্তানেরাও তাই। পিতার স্বৈরাচারের পরিচয় পরিবারের সদস্যদের সম্বোধনরীতিতেও ধরা পড়ে। আগে, সম্ভবত এখনো, সন্তানেরা পিতাকে সম্বোধন করতো ‘আপনি’ বলে, কিন্তু মাকে সম্বোধন করতো বা করে ‘তুমি’ বলে। পিতা যে প্রতাপশালী ও অপ্রতিহত, এটা বোঝে ছোটো শিশুটিও; মা যে শক্তিহীন তাও বোঝে। মা তাদের মতোই পীড়িত। বাঙালির পারিবারিক একনায়কত্বই বিস্তৃত হয় সমাজে, রাষ্ট্রে। বাঙালি সমাজে প্রধানেরা একনায়ক, তারা অন্যের মত গ্রাহ্য করে না, নিজের মত চাপিয়ে দেয় সকলের ওপর। রাষ্ট্রনায়কেরা তো প্রসিদ্ধ একনায়ক, যদিও বিশ্বের প্রধান একনায়কদের কাছে তারা ইঁদুরছানার মতো। বাঙালি একনায়কত্ব করে, ও ওপরের একনায়কের বশ্যতা মেনে নেয়। নিচের সবাই তাদের কাছে ‘ভৃত্য’, ওপরের সবাই ‘প্রভু’। একনায়কত্ব বাঙালিসমাজে বিকাশ ঘটিয়েছে স্তাবকতার। স্তাবকতায় বাঙালি কি অদ্বিতীয়? প্রভুকে তারা হাজার বিশেষণে শোভিত করে, এতো বিশেষণ তাকে উপহার দেয় যে বিধাতাকেও অতো বিশেষণে সাজানো হয় না। স্তাবকতায় যে-কোনো অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করতে পারে বাঙালি, এবং মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন অতিশয়োক্তি খুঁজে ফেরে। তবে বাঙালি কখনো প্রভুভক্ত নয়। বাঙালি জানে প্রভু শাশ্বত, কিন্তু কোনো বিশেষ প্রভু নশ্বর। এক প্রভু নিঃশেষ হয়ে গেলে বাঙালি আরেক প্রভু ধরে, আগের প্রভুর নিন্দায় মুখর হয়, জয়গানে মুখর হয় নতুন প্রভুর।