বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১১

 
সাহিত্যে মনস্তত্ত্ব
 
মোহিত কামাল
 
 
 
 
  
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রবীন্দ্র সাহিত্য আলোচনায় একজন গুণী লেখক প্রাঞ্জল ভাষায় রবীন্দ্র প্রতিভা বিশ্লেষণে কল্পনাতত্ত্বের প্রসঙ্গ টেনে উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের কল্পনাশক্তি মনস্তত্ত্বের কোনো বিষয় নয়, তাঁর কল্পনাশক্তি সৌরজগতের চেয়ে বিশাল, বড়। বক্তার প্রতি সম্মান রেখে বলছি, হ্যাঁ বড়। বিশাল। তবে যত বড়ই হোক না কেন, রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, এই শক্তির মাধ্যমে মনের মিলন বা মনস্তাত্তি্বক সংযোগের কথা। কবির এই অসীম কল্পনাশক্তি বায়বীয় কোনো বিষয় নয়। বরং এই কল্পনাশক্তি মনস্তত্ত্বেরই বিষয়-আশয়, বিশাল সৃজনক্ষমতার উৎস-উপাদান।
উপন্যাস মানে জীবনচিত্র। জীবন মানে বিজ্ঞান।
উপন্যাসের পাতায় পাতায় উঠে আসে জীবনযাপনের কাহিনী_ আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, রাগ-ক্রোধ, ঈর্ষা কিংবা প্রতিহিংসা। মনের এসব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নির্ধারণ করে দেয় চরিত্রগুলোর বাইরের আচরণ। প্রত্যক্ষণ অথবা চিন্তনের ত্রুটি-বিচ্যুতি কিংবা পরিস্থিতি মূল্যায়নে ভুলভ্রান্তি নির্মাণ করে ব্যক্তির মনোজগতের অন্তর্নিহিত রূপ, গড়ে তোলে চারপাশের আবহ। মানবমনের অন্তর্জগৎ ও চারপাশের বহির্জগতের মধ্যে রয়েছে মনস্তত্ত্বের সামঞ্জস্যপূর্ণ গোপন যোগসূত্র। অন্তর্জগতে ঝড় বইলে বহির্জগতের আবহ বদলে যায়, বদলে যায় অভিব্যক্তি। আবার বহির্জগতের পরিবর্তন হলে অন্তর্গত মানসিক প্রক্রিয়ায় বয়ে যায় বদলের হাওয়া। এই যোগসূত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে রয়েছে মনস্তাত্তি্বক সূত্র। মনঃবিশ্লেষণের মাধ্যমে সাহিত্যের ভেতর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় মনোবৈজ্ঞানিক কলাকৌশল_ প্রত্যক্ষণ, আবেগ, চিন্তা, বুদ্ধি, প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি, অবহিতি বোধ বা কগনিশন, অন্তর্গত প্রেষণা বা ভেতরের আকাঙ্ক্ষা চাহিদা-উৎসাহ-উদ্দীপনা, শিক্ষণ, বিশ্বাস, স্বপ্ন ইত্যাদি। এগুলো মনের স্বাস্থ্যের অংশ, প্রক্রিয়া বা অন্তনীল উপাদান। এ ছাড়া রয়েছে ব্যক্তিত্ব, চেতন, প্রাকচেতন ও অবচেতনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। যুগে যুগে মনোবিদরা মানুষ ও প্রাণীর আচরণ বোঝার জন্য নানা ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন। গবেষণাগুলো বিজ্ঞাননির্ভর। তাই মনোবিজ্ঞান শব্দটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিভিন্ন মতবাদের আলোকে আচরণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে মনোবিজ্ঞানে। সাহিত্যে চরিত্রগুলোর মনঃবিশ্লেষণে এই মতবাদগুলো ব্যবহার করা যায় নানাভাবে। নিউরোসায়েন্স দৃষ্টিকোণ থেকে আচরণের বায়োলজিক্যাল বা জৈবিক কারণ খোলাসা করা হয়েছে। দৃশ্যমান আচরণকে গুরুত্ব দিয়েছে বিহেভিয়ারাল পারস্পেকটিভ। হিউম্যানিস্টিক মতবাদে বলা হয়েছে, মানুষ তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, নিজের সুপ্ত প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে। সমসাময়িককালে মনোচিকিৎসাবিদ্যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট হচ্ছে কগনিটিভ ওয়ার্ল্ড। নিজের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এবং চারপাশ ও বৈশ্বিক পরিবেশ নিয়ে মানুষ কী চিন্তা করছে, কী উপলব্ধি করছে তা-ই মুখ্য এই মতবাদে। এ সময়ের একজন মনোচিকিৎসক হিসেবে মনে করি, কগনিটিভ মনোজগতের যথাযথ ব্যবহার বিশ্বসাহিত্যকে ভবিষ্যতে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে। আচরণ সৃষ্টিতে অবচেতনের অন্তর্গতশক্তির কথা বলা হয়েছে সাইকোডাইনামিক মতবাদে [সিগমুন্ড ফ্রয়েড ১৮৫৬-১৯৩৯]। অন্তর্গত এই গোপন শক্তিতে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তুলে ধরা হয়েছে ধারণাটি। মতবাদটি নানাভাবে আলোচিত, সমালোচিত। মার্কিন মুল্লুকে মনোবিজ্ঞান সমিতির বিবেচনায় কোনো স্থান না থাকলেও সাহিত্যসেবীদের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। পুরো বিংশ শতাব্দীজুড়ে শিল্পসাহিত্যে তাঁর মনস্তাত্তি্বক প্রভাব ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। ফ্রয়েডের মতে, মানবমনের সহজাত প্রবৃত্তি [ইনস্টিংক্ট] হচ্ছে জীবনপ্রবৃত্তি [ইরোস] ও মরণপ্রবৃত্তি [থেনাটোস]। ইরোসের আড়ালে আছে দেহভোগ বা দেহতৃপ্তির গোপন তাড়না কিংবা গোপন ড্রাইভ। মানুষের সব ধরনের আচরণের শেকড় গেড়ে আছে ইরোসের মূলে; যৌনতৃপ্তিই সেই শেকড়ের প্রবল চাহিদা। কিন্তু বিতর্ক আছে। মানুষ এমন অনেক আচরণ করে যার সঙ্গে দেহতৃপ্তির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফ্রয়েড যুক্তি দেখিয়ে বলেন, দুই ধরনের বিধিনিষেধের কারণে দেহতৃপ্তির আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ দেরি হয়, অথবা ভিন্ন বা পরিবর্তিত অন্য পথে লালিত গোপনইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। বিধিনিষেধের একটি হচ্ছে বাস্তবতা_ 'রিয়েলিটি' অন্যটি হচ্ছে নৈতিকতা_'মোরালিটি।' আত্মধ্বংসী প্রবৃত্তির সঙ্গে যৌনপ্রবৃত্তির দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, সংঘাত বাধে। এ কারণে ধ্বংসাত্মক তাড়নার প্রকাশ ঘটে অন্যের প্রতি সহিংস আচরণ বা আগ্রেশনের মধ্য দিয়ে। ফ্রয়েডের মতামত পরবর্তী সময়ে সবাই একশত ভাগ মেনে নেয়নি। নিরপেক্ষ পাঠককে মেনে নেওয়ার প্রয়োজনও নেই। এ বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। হেনরি মুরে এবং আব্রাহাম মাসলো মনে করেন, সব মোটিভ শারীরবৃত্তীয়, চাহিদানির্ভর নয়। কিছু কিছু মোটিভ অর্জিত হয় সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায়। মানুষের চাহিদাকে সাতটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করেছেন মাসলো_ ধাপে ধাপে সাজিয়েছেন চাহিদাগুলো। সর্বনিম্ন চাহিদা হচ্ছে শারীরবৃত্তীয় চাহিদা এবং সবার ওপর আছে পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তির চাহিদা। ফ্রয়েডীয় মতামতের পাশাপাশি এই মতবাদ বিশ্বসাহিত্যকে প্রভাবিত করলেও সুররিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ প্রাধান্য দিয়েছে এক সমগ্রতা বা অভিন্নতাকে_ যে অভিন্নতা গড়ে উঠেছে সংজ্ঞান ও অবচেতন মনের স্তরকে কেন্দ্র করে। সুররিয়ালিজমে ফ্রয়েডের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে অবচেতন মনের রহস্য উদঘাটনের কৌশল, হেগেলের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের সংস্কার এবং মার্কসের কাছ থেকে এটি গ্রহণ করেছে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আবেগ। প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সুররিয়ালিজম। ফ্রয়েডের সংজ্ঞান ও অবচেতন মনের স্তর, হেগেলের দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের সংস্কার এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আবেগ, জীবনানন্দ দাশের কাব্যধ্বনি সর্বত্রই রয়েছে মনস্তত্ত্বের নিপুণ কারুকাজ, মনঃশক্তির উদ্গ্ীরণ।
কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিকরা সৃজনশীল। তাঁরা জীবনের চিত্র খুঁড়ে খুঁড়ে, বিশ্লেষণ করে, শব্দের বুনোটে প্রতিবিম্বি্বত করতে পারেন জীবন। এভাবেই সৃষ্টি হয়ে যায় জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য সম্ভার। ব্যঞ্জনাময় উপস্থাপনার মাধ্যমে সৃজনশীল মেধার স্ফুরণ ঘটে_ সৃজনশীল সাহিত্য ও শিল্পকর্মের বিস্তৃতি এভাবেই ঘটে চলেছে সমকালে, যুগ থেকে যুগান্তরে।          
 
 
 
 
 লেখক ঃ ডাঃ মোহিত কামাল ( সংগৃহীত )
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন