শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

পরীক্ষার্থীর মানসিক চাপ কমাতে মা-বাবার ভূমিকা




পরীক্ষার্থীর মানসিক চাপ কমাতে মা-বাবার ভূমিকা

ডা. মুনতাসীর মারুফ



এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা মানসিক চাপ অনুভব করে। কেননা, শিক্ষার্থীর মাঝে পাবলিক পরীক্ষা সম্পর্কে সমাজ বা পরিবারের বিভিন্ন স্তর থেকে জানতে বা অজান্তে অহেতুক ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর আগে বহুবার পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও স্কুলে টেস্ট বা প্রি-টেস্টে এসএসসি পরীক্ষার চেয়েও কঠিন প্রশ্নপত্র পার করে এলেও জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনেকের কাছে মৃত্যুদণ্ডের আদেশের সমতুল্য ভীতিকর হয়েই দেখা দেয়।
এই মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মার অযৌক্তিক প্রত্যাশা ও ব্যবহার। অনেকের প্রত্যাশা, সেই ভালো ফলাফলটা হবে তাদের বাবা-মায়ের চাহিদামাফিক। অর্থাৎ কিনা তারা যে ফলাফলকে ভালো মনে করবেন, সন্তানকে সেই ফলাফলই নিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় বাস্তবতা বা শিক্ষার্থীর প্রকৃত ক্ষমতা-যোগ্যতা অনুধাবন না করেই তারা প্রত্যাশার এ বোঝা চাপিয়ে দেন। অনেক বাবা-মা তাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চান। এর অন্যথা হলে তারা হতাশায় ভোগেন। সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল বাবা-মা নিজেদের সামাজিক অবস্থানের নিয়ামক হিসেবে ভাবেন। সন্তান পরীক্ষায় খারাপ করলে সমাজ তাদের ‘ব্যর্থ বাবা-মা’ হিসেবে চিহ্নিত করবে এ উদ্বেগও পেয়ে বসে অনেককে। সবার যোগ্যতা ও ক্ষমতা যে এক রকম নয়-এ সত্যটি যেন তারা বুঝতে চান না। তাদের দৃষ্টিতে সন্তানের প্রত্যাশিত ফলাফলের সামান্য বিচ্যুতিও ক্ষমার অযোগ্য। পাশের বাড়ির ছেলেটির চেয়ে বা ক্লাসে একই বেঞ্চে বসা সহপাঠীর চেয়ে দুই-এক নম্বর পেছনে থাকাও তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ‘খারাপ’ ফলাফলের জন্য সন্তানকে বকাবকি, নেতিবাচক সমালোচনা, অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে সব সময় পড়াশোনা ও ফলাফল নিয়ে কটাক্ষ করতে, এমনকি শারীরিকভাবে প্রহার করতেও দেখা যায় অনেককে। বাবা-মায়ের ধারণা তারা সেটা করেন সন্তানের ভালোর জন্যই। কিন্তু ফল হতে পারে উল্টো। পরীক্ষার ফলাফলের প্রেক্ষিতে বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর ভেতর ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ সৃষ্টি করে। পরীক্ষার পড়া নিয়ে না ভেবে ফলাফলে বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়াই হয়ে ওঠে মূল ভাবনা, যা পড়াশোনায় সহায়তা না করে  উল্টো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাজনিত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দূর করতে বাবা-মা হতে পারেন সবচেয়ে বড় বন্ধু। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মায়ের অযৌক্তিক ও ভুল চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন। সন্তানের যোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিন, সেই মতো প্রত্যাশা করুন, ভালো করতে তাকে সহযোগিতা করুন, কিন্তু অতি প্রত্যাশার বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে নয়। বারবার সন্তানের নেতিবাচক সমালোচনা ও অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। ‘তোমাকে দিয়ে তো কিছুই হবে না,’ ‘তুমি পারবে না’-বাবা-মায়ের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। ইতিবাচক থাকুন। সন্তানকেও ইতিবাচকভাবে ভাবতে শেখান। পরীক্ষার দিনগুলোতে সন্তানকে বাড়তি সময় দিন, তার উদ্বেগের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, দুর্বলতা-ভীতি কাটিয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাকে উৎসাহ দিন, সহায়তা করুন। তবে বাড়তি সময় দেয়া মানে পড়ার সময় সর্বক্ষণ সামনে বসে থাকা নয়। এটাও আবার অনেক শিক্ষার্থীর জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের সুষম খাদ্য নিশ্চিত করুন। কিন্তু এ ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগ দেখাতে গিয়ে অতিভোজনে বাধ্য করে তার শরীরকে অলস ও নিদ্রাকাতর করে তুলবেন না। এ সময় বেশি খেলেই মেধা বাড়বে-এ ধারণা ঠিক নয়। পরীক্ষার্থীকে একটানা পড়তে বাধ্য করবেন না। পড়ার মাঝে বিরতি নিতে দিন। সুস্থ বিনোদন ও শরীরচর্চায় নিয়মিত কিছুটা সময় ব্যয় করতে দিন। পরীক্ষার আগের রাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে সহায়তা করুন। অধিক রাত জাগতে নিরুৎসাহিত করুন। এক বিষয়ের পরীক্ষার পর সেই বিষয়ে কী কী ভুল করল, সেবব খুঁটিয়ে বের না করে পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে সাহায্য করুন। মনে রাখবেন, পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে একটা চাপের বিষয়। বাবা বা মা হিসেবে আপনি এর সঙ্গে বাড়তি চাপ যোগ করে পরিস্থিতি সন্তানের জন্য অসহনীয় করে তুলবেন না বরং মানসিক চাপমুক্তভাবে পরীক্ষায় অংশ নিতে সন্তানকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন