বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১১

বন্ধু নির্বাচনে ইসলামের নীতিমালা

বন্ধু নির্বাচনে ইসলামের নীতিমালা
মানুষ সামাজিক জীব। এর মানে হলো- মানুষ একা হলেও সে একটি সমাজের অংশ। সমাজ গড়ে ওঠে সমষ্টিকে নিয়ে, একাকি সমাজ গঠিত হয় না। সমাজে বিচিত্র শ্রেণীর লোক বাস করে। একেক জনের পেশা একেক রকম। তাই সমাজে একজনকে আরেকজনের প্রয়োজন পড়ে। এটা আল্লাহর এক অশেষ নিয়ামত। কেননা সমাজবদ্ধতার প্রশ্নে মানুষ একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সঠিকভাবে যথার্থ বন্ধু নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে মানুষ তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ করে তোলে। এই বন্ধুত্বের ব্যাপারে ইসলামের রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি।
আপনাদেরও নিশ্চয়ই অনেক বন্ধু আছে এবং তাদের সাথে কথা বলেন, তাদেরকে দেখতে যান, তাদের সাহায্যে এগিয়ে যান এবং তারাও আপনার দুঃসময়ে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসে! কারো কারো বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা প্রচুর। আবার অনেকেই কয়েকজন বন্ধু নিয়েই তৃপ্ত, সন্তুষ্ট। অবশ্য এটা স্পষ্ট যে, বন্ধুদের মাঝে অনেকেই আছে খুবই আন্তরিক এবং সুহৃদ,ঘনিষ্ঠ এবং দুর্দিনে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুর মর্যাদা অনেক উপরে। এমনকি মানুষের সৌভাগ্যের ওপরও বন্ধুত্বের প্রভাব পড়ে। এজন্যেই নবী করিম (সা.) এবং তাঁর উত্তর প্রজন্মের ইমামগণ বন্ধু নির্বাচন করার ব্যাপারে মূল্যবান কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, 'একটি মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের অনুসারী হয়, তাই সবার ভেবে দেখা উচিত কার সাথে বন্ধুত্ব করবে।' অন্যভাবে রাসূলে খোদা (সা.) বন্ধুত্বকে এতো বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বলে মনে করেন যে বন্ধুত্ব আপন সহচরকেও নিজের ধর্মে নিজের আকিদা বিশ্বাসের দিকে নিয়ে আসে। তাই সহচরের গুরুত্ব বিশেষ করে উত্তম বন্ধুর গুরুত্ব অপরিসীম।
এ প্রসঙ্গে নবীজী বলেছেনঃ "একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর নিঃসঙ্গতা মন্দ বন্ধুর চেয়ে উত্তম।" তার মানে হলো-ভালো এবং যথার্থ বন্ধু যদি নাও থাকে তাহলেও তা একজন মন্দ ও অযোগ্য বন্ধু থাকার চেয়ে ভালো।
বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আগ-পর বিচার বিবেচনা করে নেওয়া উচিত। কারো প্রতি মন আকৃষ্ট হলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এমনটা ঠিক নয় বরং প্রথমে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে ভালো লাগা বা তার প্রতি আকর্ষণের কারণ কিংবা উৎসটা কী এবং সে আদৌ বন্ধু হবার যোগ্য কি না ইত্যাদি। আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ) থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ "যে ব্যক্তি চিন্তাভাবনা করে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।" হঠাৎ করে কারো সাথে পরিচিত হবার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনোরকম বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। অনেক ইন্টারনেট বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, এই যে আমরা বিচার বিবেচনার কথা বললাম, ইসলাম এ সম্পর্কে কী বলে অর্থাৎ একজন ভালো বন্ধুর গুণাবলী কী ইসলামের দৃষ্টিতে সেদিকে একবার নজর দেওয়া যাক।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঐ বুদ্ধি বিবেককে কাজে লাগানো। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয় এবং তার ওপর সবসময় আস্থা রাখা যায় কেননা এ ধরনের বন্ধু ভুল ত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। বিবেক-বুদ্ধিমান বন্ধুদের সাথে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে বহু বর্ণনা রয়েছে। ইমাম আলী (আ) বলেছেন, বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। বিবেকবান বন্ধু মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি করে এবং মানুষকে ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারো কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নৈতিক উপযুক্ততা ভালো বন্ধুর অপর একটি গুণ। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী ভালো বন্ধু সেই হতে পারে যে নৈতিক স্খলন থেকে দূরে থাকে। কেননা দুশ্চরিত্রবান আর মন্দ কাজে অভ্যস্ত বন্ধু শেষ পর্যন্ত মানুষকে অবৈধ, অশোভন আর অনৈতিক কাজের দিকে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনের নূরানী আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, যে বিচ্যুত এবং ফাসেকের সাথে বন্ধুত্ব করে সে আসলে নিজের ওপর নিজেই জুলুম করে। কিয়ামতের দিন তাদের অবস্থা সম্পর্কে কোরআন বলেছেঃ "হায় আমার দুর্ভাগ্য! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোঁকা দেয়।" বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছেঃ "উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে, সে-ই অধম যে চলে তফাতে।" অর্থাৎ যে ভালো, তার কোনো বয় নেই, সে ভালো-মন্দ সবার সাথেই বিনা দ্বিধায় চলতে পারে, কেননা সে খারাপ হবে না, খারাপের মাধ্যমে প্রভাবিত হবে না। তাই যে মন্দের প্রভাবের আশঙ্কায় অধমকে এড়িয়ে চলে, সে নিজেই অধম। কিন্তু মনোবিজ্ঞান এই বক্তব্যের পক্ষে নেই।
কেননা মানুষ কোনো পাথর নয় কিংবা নয় কোনো শুকনো কাঠ বিশেষ। যতোই সে চেষ্টা করুক না কেন অধমের দোষগুলো বা তার চিন্তাদর্শ থেকে অত্যন্ত সতর্কভাবে দূরে থাকতে, পারবে না। যারা সতর্ক থাকার কথা বলে তাদের ঐ বক্তব্য একান্তই ভ্রান্ত একটা দাবিমাত্র। কারণ কারো সাথে বন্ধুত্ব করলে মনের অজান্তেই তার কথাবার্তা, আচার আচরণ, কাজকর্মের প্রভাব পড়বেই। ইরানের জগদ্বিখ্যাত মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি এ সম্পর্কে লিখেছেনঃ
অসৎ বন্ধু থেকে দূরে থাকো যতোটা পারো!
সে যে বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ংকর আরো
দুষ্ট সাপ শুধু আঘাত করে তোমার প্রাণের পর
অসৎ বন্ধু ছোবল মারে প্রাণের সাথে ঈমানের পর।
ফলে অধমের সাথে উত্তমের নিশ্চিন্তে চলার বিষয়টা যুক্তিযুক্ত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্যের আরো একটি দিক হচ্ছে বন্ধুত্বের বন্ধন রক্ষা করা। ইমাম সাদেক (আ) বন্ধুত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরেছেন। যেমন বন্ধু বানাবে তাকে যে প্রথমতঃ ভেতরে- বাইরে তোমার জন্যে একইরকম। অর্থাৎ বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সততা রক্ষা করে। দ্বিতীয়তঃ তোমার ভালোকে নিজের ভালো, তোমার মন্দকে নিজের মন্দ বলে মনে করে। তৃতীয়তঃ যদি সম্পদশালী হয়ে যায় বা উচ্চ পদে আসীন হয়,তাহলে আচরণ পাল্টায় না। চতুর্থতঃ তোমাকে বিপদের মাঝে ছেড়ে চলে যায় না বা একাকী ফেলে যায় না ইত্যাদি।
বন্ধুত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো সততা রক্ষা করা। ইমাম হাসানে মুজতবা (আ) এর একজন ভক্ত একদিন ইমামের কাছে এসে তাঁর বন্ধু ও সহচর হতে চাইলো। ইমাম ঐ লোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন এবং ইতিবাচক সাড়া দিয়ে বললেনঃ "আমি তোমাকে আমার বন্ধুর মর্যাদায় অভিষিক্ত করবো তবে কয়েকটি শর্ত আছে যেগুলো আমার সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে অবশ্যই রক্ষা করে চলতে হবে।" লোকটি ইমামের শর্ত মানার প্রতিশ্রুতি দিলো। ইমাম তখন বললেনঃ "আমার বন্ধু হতে চাইলে আমার গুণকীর্তন গাইতে পারবে না, কারণ আমি নিজের ব্যাপারে ভালোভাবেই সচেতন, কখনো আমাকে মিথ্যা বলবে না কেননা মিথ্যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই; একইভাবে আমার কাছে কারো ব্যাপারে গীবত করতে পারবে না।" লোকটি এবার চুপ মেরে গেল,যেহেতু তার মাঝে এ সব গুণ ছিল না তাই সে ইমামকে বললোঃ 'হে রাসূলে খোদার সন্তান! আমাকে ফিরে যাবার অনুমতি দিন।' ইমামের মুখে হাসির রেখা লেগেই ছিল, সেই সহাস্য মুখেই তিনি বললেনঃ 'তোমার যেমন ইচ্ছে, সমস্যা নেই।'
বন্ধুকে সম্মান করা বন্ধুত্বের নীতিমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। কারণটা হলো বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে যে বন্ধন তৈরি হয়, তারফলে একজনের প্রতি আরেকজনের একটা অধিকার সৃষ্টি হয়, আর সেই অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অবশ্য কর্তব্য। সর্বোপরি একজন মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব হলো অপরের সম্মান রক্ষা করা। চাই তা নীতিকৌশল পরিবর্তনের ব্যাপারেই হোক কিংবা ব্যক্তির আচার আচরণে সংস্কার আনার ব্যাপারেই হোক, অবশ্যই সাহায্য করতে হবে। ইমাম আলী (আ.) একদিন কুফায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে এক ইহুদির সাথে দেখা। ঐ ইহুদি লোকটিও কুফার দিকেই যাচ্ছিল। ইহুদি লোকটি হযরত আলী (আ.)কে চিনতো না এবং জানতোও না যে তিনিই মুসলমানদের খলিফা। কিন্তু একই গন্তব্যের যাত্রী যেহেতু সেজন্যে আলী (আ.) সাথেই যাচ্ছিলো। যেতে যেতে এক সময় দুজনের মাঝে কিছু কথাবার্তা হলো। কথা বলতে বলতে একটি তেমোহনীতে এসে পৌঁছলো। সেখান থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে কুফার দিকে অপরটি তার আশপাশের কোনো এলাকার দিকে।
ইমাম আলী (আ.) ঐ তেমোহনীতে এসে কুফার পথে পাড়ি না জমিয়ে অপর পথে অগ্রসর হয়ে ইহুদি লোকটিকে সঙ্গ দিলেন। ইহুদি লোকটি জানতো যে তার সঙ্গী অর্থাৎ আলী (আ.) কুফায় যাবে, এখন ভিন্নপথে যাচ্ছে দেখে জিজ্ঞেস করলোঃ 'তুমি না বলছিলে কুফায় যাবে?' ইমাম বললেনঃ হ্যাঁ,বলেছি। ইহুদি লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ 'তুমি তো কুফার পথ চেনোই, তাহলে আমার সাথে আসছো কেন'? ইমাম জবাবে বললেনঃ 'আমরা চলার পথে বন্ধু হয়েছি, বন্ধুত্বপূর্ণ সফরের শুভ পরিসমাপ্তির জন্যেই তোমার সাথে যাচ্ছি,কেননা আমাদের নবী রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন পথিক বন্ধুর প্রতি সম্মান দেখানোর স্বার্থে বিচ্ছিন্ন হবার সময় কিছুটা পথ বন্ধুকে সঙ্গ দেওয়া উচিত অর্থাৎ তাকে কিছুটা এগিয়ে দেওয়া উচিত।' ইহুদি লোকটি জিজ্ঞেস করলোঃ সত্যিই তোমাদের নবী এরকম বলেছেন?' ইমাম বললেনঃ হ্যাঁ।
ইহুদি লোকটি ইমাম আলী (আ.) এর চিত্ত্বাকর্ষক এই আচরণ আর নৈতিকতায় মুগ্ধ হয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মুসলমান হয়ে যান।
বন্ধুত্বের নীতিমালার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হচ্ছে অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদেও বন্ধুত্ব অটুট রাখা। যেমনটি কবি সাদি বলেছেনঃ 'বন্ধু হলো সে-ই, যে বন্ধুর হাত ধরে মানসিক অস্থিরতা আর চরম দুরবস্থায়'। লোকমান হাকিম বলেছেনঃ 'প্রয়োজনের মুহূর্ত ছাড়া বন্ধুকে চেনা যায় না।' কেউ যখন অসুস্থতায় ভোগে তখন তার প্রতি সেবাযত্নের প্রয়োজন হয়, সে সময় অসুস্থ ব্যক্তি আশা করে বন্ধুরা তার সেবায় এগিয়ে আসবে। নবীজীর আহলে বাইতের মহান ইমাম হযরত আলী (আ.) যখন শুনতে পেলেন তাঁর বন্ধু হারেস হামেদানী অসুস্থ এবং একেবার মরণাপন্ন অবস্থা, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর সেবায় যাবেন এবং যথারীতি চলে যান। ঘরে ঢুকে হারেসের শিয়রে বসলেন। হারেস তার চোখ মেলে আমিরুল মোমেনিন (আ.) কে দেখতে পেল তার পাশে। ইমাম তার খোঁজখবর নিলেন এবং তার মনস্তুষ্টির জন্যে তিনবার বললেনঃ 'হে হারেস! পরকালেও এই দুনিয়ার বন্ধুকে বন্ধু হিসেবে পাবে এবং তার সাহচর্য ধন্য হবে'। হারেস যেহেতু ইমামকে ভীষণ ভালবাসতো, ইমামের একথায় ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের জন্যে একটু ভালো অনুভব করে উঠে বসে বললো। 'এখন আর কোনো ভয় কিংবা শঙ্কা নেই যে আমি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবো নাকি মৃত্যু আমার দিকে এগিয়ে আসবে।' এর কিছুক্ষণ পরই হারেস মৃত্যুবরণ করেন।
বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হলো ব্যক্তিগত অহমিকা বা গর্ব পরিহার করা। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যখন গভীর হয় তখন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাছ থেকে কেবল যে সম্মানই পায় তা-ই নয় বরং নিজেকে কেউ বড়ো করে দেখারও চেষ্টা করে না, অহংকারও করে বেড়ায় না। পবিত্র কোরআনের সূরা যুমারের ষাট নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ 'অহংকারীদের স্থান হচ্ছে দোযখ।' সূরা শুয়ারার ২১৫ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছেঃ 'আপনাকে যারা অনুসরণ করছে সেইসব মুমিনের জন্যে আপনার পাখা বিস্তৃত করুন অর্থাৎ তাদের প্রতি সদয় হোন।' ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুদের সাথে আচরণ হতে হবে সদয়, আন্তরিক এবং বিনয়ী। তবে গঠনমূলক সমালোচনাও বন্ধুত্বের মাঝে বিদ্যমান অনিবার্য একটি শিষ্টাচার। হাদিসে এসেছে, রাসূলে খোদা (সা) বলেছেনঃ 'এক মুমিন আরেক মুমিনের জন্যে আয়নার মতো।' তাই বন্ধুর দোষত্রুটিগুলো শোধরানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করা শিষ্টাচারভুক্ত। কেননা এতে মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। গঠনমূলকভাবে বন্ধুরর দোষগুলো ধরে দিলে বন্ধু রাগ তো করবেই না বরং ভাববে সেই তো পরম শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই তাদের মধ্যকার বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় আরো গভীর হবে। তবে কখনো ভুল করলে ক্ষমা চাওয়াটাও একটা শিষ্টাচার। কেননা ভুল স্বীকারের মধ্যেই রয়েছে সংশোধনের বীজ। ইমাম আলী (আ) এর ভাষ্য অনুযায়ী 'সবচেয়ে মন্দ লোক হলো সে-ই যে ভুল স্বীকার করতে রাজি নয়।' 



(collected )

বন্ধু দিবসের সাতকাহন

বিশ্ব বন্ধু দিবস। সবাই হয়তো জানেন, আগস্ট মাসের ১ম রবিবারটাই পালিত হয় বন্ধু দিবস হিসেবে। আচ্ছা, এই দিবসের সংঙ্গাটা একটু অদ্ভুত না? ১লা জানুয়ারী, ২১শে ফেব্রুয়ারীর মতো নির্দিষ্ট কোন তারিখ না, বরং আগস্ট মাসের ১ম রবিবার। রবিবার । কেন? কেন মঙ্গল কিংবা বৃহস্পতি বার না? কখনো এই প্রশ্ন আসেনি মনে? আপনার এসেছে কিনা জানিনা, তবে আমার এসেছে। তাইতো গুগলে মেতেছিলাম অনেকটা সময়। শেষ পর্যন্ত যা পেলাম তার সারমর্ম এই-

১৯৩৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস বন্ধুত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করে একটা দিনকে ‘জাতীয় বন্ধু দিবস’ [১]। এর পিছনে কারণ কী ছিল, তা নিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হয় - ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর জনমনে যে অবিশ্বাস আর শত্রুতা জন্ম নিয়েছিল তার প্রেক্ষিতেই বন্ধু দিবসের শুরু। লক্ষ্য করুন - ‘জাতীয়’ বন্ধু দিবস, ‘আন্তর্জাতিক’ নয়। তাহলে এটা আন্তর্জাতিক হল কবে? জাতিসংঘের মতো কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকেও এ ঘোষণা এসেছে বলে কোন তথ্য পাইনি। আসলে যা হয়েছে - যুক্তরাষ্ট্রে এ দিবসের সাফল্য দেখে অন্যান্য দেশও তা পালন করতে থাকে। কালে তা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে। তবে এই আন্তর্জাতিক রূপ সার্বজনীন নয়। কিছু দেশ আছে যারা একই দিনে বন্ধু দিবস পালন করেনা। যেমন, দক্ষিন আমেরিকার কিছু দেশে যেখানে ২০শে জুলাই বন্ধু দিবস, সেখানে প্যারাগুয়েতে তা ৩০শে জুলাই [২]। আবার চিলিতে নিয়মটা হল - অক্টোবরের প্রথম শুক্রবার। এদিকে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধু দিবস পালন করা হয় ২য় টার্মের ৩য় কার্যক্ষম শুক্রবার (3rd working Friday)[৩]।

অ! যে কারণে গুগলের আশ্রয় নিয়েছিলাম - তাইতো বলা হল না। কেন রবিবার? আসলে এরও কোন সনির্দিষ্ট কারণ পাইনি। অগত্যা সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনার আশ্রয় নিতে হল। আমার যা মনে হয় - যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। আর বন্ধু দিবস হিসেবে এমন একটা দিনকে বেছে নেয়া হয়েছে যেদিন সকলে কাজকর্মের চিন্তা দূরে রেখে সবার সাথে নিশ্চিন্তে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে। আর আমার ভিতরে গন্ডগোলটাও এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রের লোক যদি তাদের সুবিধামতো (এবং অবশ্যই যুক্তিসংগত) দিনে বন্ধু দিবস পালন করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারিনা? আর এটা তো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোন সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিতও না। তাহলে আমরা কেন আগষ্টের ১ম শুক্রবারকে বন্ধু দিবস বলিনা? আমার ছোট্ট মাথায় এর উত্তর আসে না।


 ( সংগৃহীত )

মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি, হুমায়ুন আহমেদ

হুমায়ুন আহমেদ এর সাথে আমার প্রথম দেখা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে- উনার খাস কামরায়।

আমি নিজেও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্ত অবস্থান করতাম তার থেকে যোজন যোজন দুরের ডিপার্টমেন্টে। লিটল ম্যাগাজিন এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তো কোন একটা সংখ্যায় ১৪ ফেব্রুয়ারীর ছাত্র আন্দোলন নিয়ে তার মন্তব্য জানার জন্য তার কাছে গিয়েছিলাম। সালাম দিয়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলতেই উনি বললেন- আসলে কি জানো পুরো ব্যাপারটাই (ফেব্রুয়ারীর ছাত্র আন্দোলন) আমার অন্যের মুখে শোনা, কিছুটা পত্রিকার পাতায় দেখা। আমি তো তখন দেশের বাইরে........

উনি এরপর জরুরী কাজে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, আমাকে বললেন- চলো, গাড়ীতে যেতে যেতে বাকী আলাপ করে ফেলা যাবে। সে সময় টেলিভিশনে উনার একটা ধারাবাহিক চলছিল-নাম ভুলে গেছি, ওই যেটার মধ্যে আফজল অভিনয় করেছিল ডাক্তার চরিত্রে, আর খুব বোকা বোকা সব কান্ড করতো।

গাড়ীতে উঠে আমি বললাম- আপনার ওপর ডাক্তাররা তো ভীষন ক্ষেপে আছে, আপনি নাকি ডাক্তারদের ভাবমুর্তি ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন? উনি হাসলেন-আরে শুধু ডাক্তারদের কথা বলো কেন, সৈয়দ বংশের লোকেরাও মহা ক্ষিপ্ত, আচ্ছা বলো তো- সবাই সিরিয়াসলি সব কিছু নেয় কেন, নাটক তো নাটকই। আমাকে অনেকে বলেছে- এই যে আমার নাটকে আমি কাজের লোকদের দেখাচ্ছি তারা ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে, তো এটা আমি ব্যক্তিগত জীবনে অনুশীলন করবো কিনা। যদি তা না করি তবে কেন এসব ভন্ডামী করছি। এখন এর উত্তরে আমি কি বলতে পারি, এটা তো বুদ্ধিমানের মতো কথা হলো না। আমি আর আমার নাটকের চরিত্র তো এক জিনিষ না, ডেফিনিটলি আমি আমার বাসায় কাজের লোকদের ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়া এলাও করবো না, কারন আমি তো অমুক (উনার নাটকের সেই চরিত্রের নাম বললেন, যেটায় আবুল হায়াত অভিনয় করেছিলেন) নই। জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি তো আমার নয়। ফলে আমাকে কেন তার মতো আচরন করতে হবে?
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম- আসলে বাঙালীর সেন্স অব হিউমার কমে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এর পর বিপদ এড়াতে আপনার পরবর্তী নাটকের চরিত্র গুলো ভীনগ্রহের- এ্যটলিষ্ট বাংলাদেশের বাইরে থাকে আনা উচিত.......

আমার কথায় উনি হাসলেন।


( collected )

সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১১

রবি ঠাকুরের জমিদারি বনাম কবি নজরুলের জঠর জ্বালা

রবি ঠাকুরের জমিদারি বনাম কবি নজরুলের জঠর জ্বালা

দুঃখ যেন তার পিছু ছাড়ছে না। চরম দুঃখ-যাতনা ছিল কাজী নজরুলের জীবন সাথী। ১৯০৭ সালে বয়স যখন আট তখন তিনি পিতা হারান। সে সময়ে দারিদ্রতা আর সৎ ভাইয়ের অবহেলায় তিনি বাউণ্ডেলে জীবন যাপন শুরু করেন। লেটোর দলে, চায়ের দোকানে কাজ করেন। নজরুল যখন দুঃখ-কষ্টের অথৈ দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন তার মা জাহেদা খাতুন বিয়ে করেন তার চাচাকে। কাটা ঘায়ে নূনের ছিটার মতো মনে হলো নজরুলের কাছে। মা বিয়ে করেছিলেন নজরুলের বোন কুলসুমকে বিয়ে দেয়ার নাম করে। কিন্তু তিনি এ বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি। লজ্জায় ক্ষোভে নজরুল কোনো দিন তার মায়ের সামনে যান নি। এমনকি ১৯২৩ সালে হুগলির জেলে তার মা দেখা করতে গেলেও তিনি দেখা করেন নি। জাগরণের কবি, পরিবর্তনের কবি, সাম্যের কবি, ইনসাফের কবি, মৈত্রীর কবি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কবি, সত্য প্রকাশের অকুতোভয় কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের প্রতি কি আমরা কম অবহেলা করছি? আমরা তো তার সৎ ভাইয়ের মতোই তার প্রতি আচরণ করছি। তাকে যদি আমরা এত অবহেলাই করবো তবে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিলাম কেন? আমরা আমাদের জাতীয় কবিকে আড়ালে রেখে ভিন দেশের বিশ্ব কবিকে নিয়ে যেভাবে মাতামাতি শুরু করছি তাতে মনে হয় আমরা মাসির ভূমিকায় নেমেছি। অথচ ভারতে রবি ঠাকুরকে নিয়ে এতো মাতামাতি নেই। যে সময়ে রবি ঠাকুর জমিদারি শুরু করেন সে সময়ে নজরুল জঠর জ্বালায় কাতর। এক টুকরো রুটির জন্য চায়ের দোকানে শ্রম বিক্রি করেন। যে বছর রবি ঠাকুর সাহেত্যে নোবেল প্রাইজ পান সে বছর নজরুল দু'কলম বিদ্যা অর্জনের জন্য লজিং বাড়ীতে উঠেন। যে সময়ে রবি ঠাকুর ইংরেজদের অতি প্রিয় 'কবি' সে সময়ে নজরুল ইংরেজদের অতি ভয়ংকর শত্রু। নজরুল চাইলে ইংরেজদের পদলেহন করে দু'পয়সা কামাই করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা না করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কবিতা লেখেন, ঘুমন্ত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলেন। আর আমাদের বিশ্ব কবি দখলদার ইংরেজদের গুণগান গেয়ে কবিতা লেখেন। অসামপ্রদায়িক নজরুল ছিলেন মানব দরদী এক মহান কবি। নজরুল ছিলেন বঞ্চিতদের বলিষ্ট কষ্টস্বর। ধর্ম-বর্ণের উর্দ্ধে ছিলেন তিনি। তিনি হিন্দু-মুসলিম সকলের কল্যাণে কাজ করেছেন। অপরপক্ষে মুসলিমরা শিক্ষিত হউক তা আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ চাইতেন না। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন। ভাগ্যের কী নিমর্ম পরিহাস আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে রবি বন্দনার জোয়ার বইছে। আমরা আজ নজরুলকে আঁধারে রেখে রবির পূজায় মশগুল। রবির আদর্শের কাঙ্গাল! দুখু মিয়ার দুখের যেন শেষ নেই। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ গ্রহণের জন্য আমরা আজ প্রতিযোগিতায় নেমেছি। কার চেয়ে কে বেশী রবীন্দ্র ভক্ত তা প্রমাণের জন্য একেকজন গলদ্ঘর্ম। রবি ঠাকুরের আদর্শ হচ্ছে ভোগের আর নজরুলের আদর্শ ত্যাগের। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচারী রাজ শক্তিকে প্রণাম করা আর নজরুলের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচারী রাজ শক্তির বিরোদ্ধে বিদ্রোহ করা, প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ করা। আজ সারা বিশ্বে অত্যাচারী রাজ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই সময়ের দাবী হচ্ছে নজরুলের আদর্শে উজ্জিবিত হয়ে আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলা করা । রবীন্দ্রনাথের আদর্শ গ্রহণ করে বিশ্ব মোড়লদেরকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয়। আজ ১১২তম জন্ম দিনে নজরুলের প্রতি রইল আমাদের দোয়া। তাকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। কলকাতার সুবিধা ভোগী কিছু বুদ্ধিজীবী যারা রবির দরদে আজ প্রায় উম্মাদ তারাও জানেন নজরুল নিমোর্হের কবি, সত্যিকারের সাম্যের কবি আর রবি ঠাকুর সামপ্রদায়িক কবি, অত্যাচারী রাজ শক্তির অনুকুলের কবি। তার পরও তারা জেনে শুনে ভন্ডামী করছেন। এই ভন্ডদের প্রতি নজরুলের ভাষায়- দোহাই তোদের। এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল। ঢের দেখালি ঢাক ঢাক গুড় গুড় ঢের মিথ্যা ছল। পেটে এক আর মুখে আরেক এই যে তোদের ভন্ডামী। এতেই তোরা লোক হাসালি বিশ্বে হলি কম দামী।


(  সংগৃহীত )

শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১১

পেশাজীবী বা বৃত্তিজীবীদের ক্ষেত্রে সফলতার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?

পেশাজীবী বা বৃত্তিজীবীদের ক্ষেত্রে সফলতার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?

Question: 
পেশাজীবী বা বৃত্তিজীবীদের ক্ষেত্রে সফলতার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
Answer: 
পেশাজীবী অর্থাৎ একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লইয়ার, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট বা কনসালটেন্ট হিসেবে যখন একজন স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকেন তখন সেখানে সাফল্য অর্জনের জন্যে চারটি বিষয় প্রয়োজন। প্রথমত, উদ্যম- নতুন কিছু, বড় কিছু করার। দ্বিতীয়ত, পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা। তৃতীয়ত, পেশার প্রতি ভালবাসা, আন্তরিকতা এবং দায়িত্ব পালনে বিশ্বস্ততা। চতুর্থত, জনসংযোগ বা পরিচিতি। এই চারটি বিষয় যদি একজন পেশাজীবী আয়ত্ত করেন তিনি শুধু বৈষয়িকভাবে সফল হবেন তা নয়, একজন সৃজনশীল কীর্তিমান পেশাজীবী হিসেবেও স্মরণীয় হবেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ পেশাজীবী বিপুল অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে সাফল্যের এ শর্তগুলো অবহেলা করেন। ফলে একসময় পেশাজীবীদের যে মর্যাদার চোখে দেখা হতো এখন তা অনেকটাই দুর্লভ।
যেমন, ৭০ এর দশক পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছিলেন যাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। কিন্তু এরপর থেকে পট বদল হতে লাগলো। জ্ঞানচর্চায় ব্রতী ছাত্র অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকের জায়গায় এসে দাঁড়ালো অর্থোপার্জনের নেশায় পাগল দিনমান প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে ব্যস্ত শিক্ষক নামের কিছু আত্মকেন্দ্রিক মানুষ। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যে রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি থেকে শুরু করে ছাত্রদের ব্যবহার করতেও তাদের দ্বিধা হয় না। যদিও এখনও অনেক শিক্ষক আছেন যারা সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধেয় তাদের গভীর জ্ঞান, পান্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শের জন্যে। কিন্তু এখনকার সাধারণ প্রবণতা হলো রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত শিক্ষক সুযোগ পেলেই ক্লাস বর্জন, ধর্মঘট, রাস্তায় আন্দোলন ইত্যাদির ঘোষণা দেন। এতে তার ছাত্র-ছাত্রীরা জ্ঞানার্জনে পিছিয়ে পড়ুক কিংবা সেশন জ্যামে আটকে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ুক- তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। মজার ব্যাপার হলো, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না নিয়ে মহা উৎসাহে ধর্মঘট পালন করলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক সময়েই তিনি হাজিরা দেন। কারণ মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে সেখানে তিনি বা তার ছাত্ররা এ জাতীয় আন্দোলনের কথা দূরতম কল্পনাতেও ভাবতে পারেন না।
আসলে একজন পেশাজীবী শিক্ষক হতে পারেন বা ডাক্তার হতে পারেন। কিন্তু নীতিগতভাবে তিনি কখনো বলতে পারেন না যে, আমি পড়াবো না বা আমি রোগী দেখবো না- যতক্ষণ তিনি একজন শিক্ষক বা ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত আছেন। যেকোনো সময় সেবা দেয়ার জন্যে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। একজন মানুষ যেকোনো সময় এলে যাতে আপনার সেবা পেতে পারে। ধরুন, আপনি একজন দর্জি। এটাও একটা স্বাধীন পেশা। আপনি কাপড় তৈরি করেন, আপনাকে প্রত্যেকের মাপমতোই কাপড় তৈরি করতে হবে। মি. এক্স এর মাপে মি. ওয়াই এর কাপড় বানালে কী হবে? বা আপনি তাকে যে সময় বললেন যে কাপড় তৈরি করে দেয়া হবে তার অন্তত একদিন আগে কাপড়টি তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে সে আসার সাথে সাথে তাকে দিতে পারেন। দুইদিন আগে করে রাখতে পারলে আরো ভালো।
আর একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের এটা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়, আজকে তার এই অবস্থান তৈরির জন্যে কত নিরন্ন মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তিনি প্রায় বিনা পয়সায় বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এখন তার যে বেতন সেটার অর্থায়নও হয় এই ট্যাক্সের টাকায়। নিজের বিবেকের কাছেই তার জিজ্ঞেস করা উচিত এই ঋণ বা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তির কতটা চেষ্টা তিনি করেছেন। ক্লাস বর্জনে বা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তার ঋণের বোঝা কি দিনে দিনে আরো বাড়ছে না? হ্যাঁ, তিনি অবশ্যই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে যতক্ষণ একটি জায়গায় সেবাদানের চুক্তিতে তিনি আবদ্ধ ততক্ষণ ঐ দায়িত্বই পালন করতে হবে চূড়ান্ত নিষ্ঠার সাথে। যখন যা খুশি করার কোনো অধিকার আর তখন থাকে না বা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে যাওয়ার দ্বৈত নীতি অনুসরণ করার সুযোগও আর থাকে না। তা করলে তিনি তার শপথেরই লঙ্ঘন করলেন। আর তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি শ্রদ্ধা হারাবেন। কারণ শুধু পদ-পদবি বা কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানে থাকলেই শ্রদ্ধা পাওয়া যায় না। শ্রদ্ধা পাওয়ার জন্যে ব্যক্তিকেই কাজ করতে হবে সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে।
আর বৃত্তির ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বস্ততা বলতে বোঝায়- ধরুন, আপনি পরার্মশ দিচ্ছেন একজনকে। পরামর্শদাতা হিসেবে আপনাকে বিশ্বস্ত হতে হবে। যদি আপনি বিশ্বস্ত না হন, যারা পরামর্শ নিতে আসছেন তারা যদি মনে করেন যে সে যা বলছে তা আপনি কাউকে বলে দিতে পারেন। তাহলে আপনি পরামর্শদাতা হিসেবে ব্যর্থ হবেন। কেউ আপনার কাছে পরামর্শের জন্যে আসবে না। তাই আপনাকে আপনার পেশার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে।

পরীক্ষার্থীর মানসিক চাপ কমাতে মা-বাবার ভূমিকা




পরীক্ষার্থীর মানসিক চাপ কমাতে মা-বাবার ভূমিকা

ডা. মুনতাসীর মারুফ



এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা মানসিক চাপ অনুভব করে। কেননা, শিক্ষার্থীর মাঝে পাবলিক পরীক্ষা সম্পর্কে সমাজ বা পরিবারের বিভিন্ন স্তর থেকে জানতে বা অজান্তে অহেতুক ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এর আগে বহুবার পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও স্কুলে টেস্ট বা প্রি-টেস্টে এসএসসি পরীক্ষার চেয়েও কঠিন প্রশ্নপত্র পার করে এলেও জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনেকের কাছে মৃত্যুদণ্ডের আদেশের সমতুল্য ভীতিকর হয়েই দেখা দেয়।
এই মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিতে পারে পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মার অযৌক্তিক প্রত্যাশা ও ব্যবহার। অনেকের প্রত্যাশা, সেই ভালো ফলাফলটা হবে তাদের বাবা-মায়ের চাহিদামাফিক। অর্থাৎ কিনা তারা যে ফলাফলকে ভালো মনে করবেন, সন্তানকে সেই ফলাফলই নিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় বাস্তবতা বা শিক্ষার্থীর প্রকৃত ক্ষমতা-যোগ্যতা অনুধাবন না করেই তারা প্রত্যাশার এ বোঝা চাপিয়ে দেন। অনেক বাবা-মা তাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সন্তানের মাধ্যমে পূরণ করতে চান। এর অন্যথা হলে তারা হতাশায় ভোগেন। সন্তানের পরীক্ষার ফলাফল বাবা-মা নিজেদের সামাজিক অবস্থানের নিয়ামক হিসেবে ভাবেন। সন্তান পরীক্ষায় খারাপ করলে সমাজ তাদের ‘ব্যর্থ বাবা-মা’ হিসেবে চিহ্নিত করবে এ উদ্বেগও পেয়ে বসে অনেককে। সবার যোগ্যতা ও ক্ষমতা যে এক রকম নয়-এ সত্যটি যেন তারা বুঝতে চান না। তাদের দৃষ্টিতে সন্তানের প্রত্যাশিত ফলাফলের সামান্য বিচ্যুতিও ক্ষমার অযোগ্য। পাশের বাড়ির ছেলেটির চেয়ে বা ক্লাসে একই বেঞ্চে বসা সহপাঠীর চেয়ে দুই-এক নম্বর পেছনে থাকাও তারা সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ‘খারাপ’ ফলাফলের জন্য সন্তানকে বকাবকি, নেতিবাচক সমালোচনা, অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে সব সময় পড়াশোনা ও ফলাফল নিয়ে কটাক্ষ করতে, এমনকি শারীরিকভাবে প্রহার করতেও দেখা যায় অনেককে। বাবা-মায়ের ধারণা তারা সেটা করেন সন্তানের ভালোর জন্যই। কিন্তু ফল হতে পারে উল্টো। পরীক্ষার ফলাফলের প্রেক্ষিতে বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীর ভেতর ফলাফল নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ সৃষ্টি করে। পরীক্ষার পড়া নিয়ে না ভেবে ফলাফলে বাবা-মায়ের প্রতিক্রিয়াই হয়ে ওঠে মূল ভাবনা, যা পড়াশোনায় সহায়তা না করে  উল্টো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরীক্ষার্থীর পরীক্ষাজনিত উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা দূর করতে বাবা-মা হতে পারেন সবচেয়ে বড় বন্ধু। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মায়ের অযৌক্তিক ও ভুল চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন। সন্তানের যোগ্যতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নিন, সেই মতো প্রত্যাশা করুন, ভালো করতে তাকে সহযোগিতা করুন, কিন্তু অতি প্রত্যাশার বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে নয়। বারবার সন্তানের নেতিবাচক সমালোচনা ও অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। ‘তোমাকে দিয়ে তো কিছুই হবে না,’ ‘তুমি পারবে না’-বাবা-মায়ের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয়। ইতিবাচক থাকুন। সন্তানকেও ইতিবাচকভাবে ভাবতে শেখান। পরীক্ষার দিনগুলোতে সন্তানকে বাড়তি সময় দিন, তার উদ্বেগের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, দুর্বলতা-ভীতি কাটিয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাকে উৎসাহ দিন, সহায়তা করুন। তবে বাড়তি সময় দেয়া মানে পড়ার সময় সর্বক্ষণ সামনে বসে থাকা নয়। এটাও আবার অনেক শিক্ষার্থীর জন্য চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানের সুষম খাদ্য নিশ্চিত করুন। কিন্তু এ ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগ দেখাতে গিয়ে অতিভোজনে বাধ্য করে তার শরীরকে অলস ও নিদ্রাকাতর করে তুলবেন না। এ সময় বেশি খেলেই মেধা বাড়বে-এ ধারণা ঠিক নয়। পরীক্ষার্থীকে একটানা পড়তে বাধ্য করবেন না। পড়ার মাঝে বিরতি নিতে দিন। সুস্থ বিনোদন ও শরীরচর্চায় নিয়মিত কিছুটা সময় ব্যয় করতে দিন। পরীক্ষার আগের রাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে সহায়তা করুন। অধিক রাত জাগতে নিরুৎসাহিত করুন। এক বিষয়ের পরীক্ষার পর সেই বিষয়ে কী কী ভুল করল, সেবব খুঁটিয়ে বের না করে পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতিতে মনোযোগ দিতে সাহায্য করুন। মনে রাখবেন, পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে একটা চাপের বিষয়। বাবা বা মা হিসেবে আপনি এর সঙ্গে বাড়তি চাপ যোগ করে পরিস্থিতি সন্তানের জন্য অসহনীয় করে তুলবেন না বরং মানসিক চাপমুক্তভাবে পরীক্ষায় অংশ নিতে সন্তানকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

আপনার সন্তান কেন আপনার কথা শোনে না

আপনার সন্তান কেন আপনার কথা শোনে না

  • তিরস্কার বা সারাক্ষণ আদেশ-নির্দেশ না করে সন্তানকে তার করণীয় যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন
    তিরস্কার বা সারাক্ষণ আদেশ-নির্দেশ করতে থাকলে সন্তান ভাবতে পারে যে আপনি বোধ হয় তার প্রতিপক্ষ। কিন্তু আপনি সন্তানের বন্ধু - এই অনুভূতিটি তার বিকাশের জন্যেই জরুরি। আর বড়দের মতো ছোটদের জন্যেও এই ব্যাখ্যাটা জরুরি যে সে কেন কাজটি করবে।
  • আপনার সন্তানকে বুঝতে দিন যে আপনি তাকে বোঝেন
    যত আপনার সন্তান বুঝবে যে আপনি তাকে বোঝেন তত সে আপনার অনুগত হবে। আপনার কথা শুনবে। অতএব তাকে শোনানোর জন্যে আগে তাকে শুনুন। তার কথায় মনোযোগ দিন।তাকে বুঝতে দিন যে আপনি তাকে বোঝেন।তার পরিবর্তন দেখে অবাক হয়ে যাবেন।
  • সন্তানের ব্যাপারে একমত হোন
    সন্তানের ব্যাপারে বাবা-মার ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ। একই ব্যাপারে বাবা-মা ভিন্ন মত দেবেন না। এতে সন্তান বিভ্রান্ত হয়। আগেই সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে নিন। আর কোনো ব্যাপারে দ্বিমত হলে তা নিয়ে কখনো সন্তানের সামনে বিতর্কে জড়াবেন না। নিজেরা কথা বলুন।
  • সন্তানের প্রশ্নের জবাব দিন
    আপনি যদি আপনার সন্তানের প্রশ্নের জবাব না দেন, জবাবের জন্যে সে হয়তো খুঁজে নেবে এমন কাউকে বা এমন কিছুকে যার পরিণতি আপনার জন্যে অতটা সুখকর না-ও হতে পারে।
  • সন্তানকে তা-ই বলুন যা আপনি নিজেও পালন করেন
    শিশুরা তাদের বাবা-মায়েরা কী বলছে সেটা নয়, কী করছে সেটাই অনুকরণ করে। কাজেই আপনার সন্তানকে এমন কিছু করতে বলবেন না যা আপনি নিজেই করেন না।
  • ভুল করলে মাশুল পেতে দিন, প্রয়োজনে শাস্তি দিন
    আপনার সন্তান যদি বোঝে যে আপনার কথা না শুনেও সে পার পেয়ে যাচ্ছে, তাহলে সে অবাধ্য হতে উৎসাহ পাবে। তাই সারাক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি না করে শান্ত থাকুন, কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করুন। এ ব্যাপারে দৃঢ় হতে ভয় পাবেন না। কারণ সন্তান যদি বুঝতে পারে যে এই অবাধ্য হবার জন্যে তাকে শাস্তি পেতে হবে, তাহলে সে সাবধান হবে।
  • একই কথা বার বার বলবেন না
    একই কথা বার বার বললে তার গুরুত্ব কমে যায়। এর চেয়ে ১ বার বলুন। তাকে বুঝতে দিন না শোনার শাস্তি।
  • জেনারেশন গ্যাপকে মিটিয়ে ফেলুন
    সন্তানের সাথে জেনারেশন গ্যাপের একটা কারণ হলো বাবা-মায়েরা চান তারা তাদের ছোটবেলায় যেমন ছিলেন, সন্তানও ঠিক তেমন হবে। ফলে এই অবাস্তব প্রত্যাশার জন্যে সৃষ্টি হয় ভুল বোঝাবুঝি। কাজেই কিছু কিছু ব্যাপারে আপনাকে সহনশীল হতে হবে। সন্তানের চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পছন্দের সাথে আপনার চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পছন্দের একটা ভারসাম্য আনতে হবে। যেমন, প্রযুক্তির ব্যাপারে বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ, দক্ষতা, সম্ভাবনা সবকিছুই পুরনো প্রজন্মের চেয়ে বেশি। এটি যদি বড়রা মেনে নেন, এ গুণের জন্যে তাদের প্রশংসা করেন, সমীহ করেন, তাহলেই কিন্তু একটা সুন্দর বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হয়।
  • আপনার অপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তবায়ন সন্তানের মধ্যে দেখতে যাবেন না
    বাবা-মায়েরা অনেক সময় তাদের অপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চান তার সন্তানের মধ্যে। ফলে সন্তানের জীবনের লক্ষ্য কী হবে তা তারাই ঠিক করে দেন সন্তানের চাওয়া বা সামর্থ্যের বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে। আর পরবর্তীতে তার মাশুল দিতে হয় সন্তানকেই। সে না পারে বাবা-মায়ের চাওয়া পূরণ করতে, না পারে নিজের মেধাকে বিকশিত করতে। কাজেই বেড়ে ওঠার একটি পর্যায়ের পরে তার সব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে চিন্তা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা দিন। এতে সে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।
  • সন্তানের আত্মমর্যাদাবোধকে নষ্ট করবেন না
    শিশুদেরও যে আত্মমর্যাদাবোধ আছে এটা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। আমরা হয়তো অন্যের সামনে তাকে বকাবকি করি, ভুল ধরিয়ে দেই বা অপ্রস্তুত করি। এ ধরনের আচরণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। ‘তোকে দিয়ে কিছু হবে না’- এ জাতীয় কথা বলেও তাকে ছোট করবেন না। ব্যর্থতার প্রসঙ্গ তুলে খোঁটা দেবেন না, আপনার উৎসাহ তার ব্যর্থতাকেও সাফল্যে রূপান্তরিত করতে পারে।

বন্ধুত্ব ধারণা ও বাস্তবতা

দুঃখ আনন্দের মমতাপূর্ণ ভাগীদার ছাড়া জীবন এক বিরান মরুভূমি ছাড়া কিছুই নয় দার্শনিক এমারসন বলেছেন, একজন বন্ধু হচ্ছেন প্রকৃতির সবচেয়ে বড় মাস্টারপিস বন্ধুত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্যে কবি বা দার্শনিক হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই আপনার আনন্দ এবং দুঃখে আপনার পাশে কেউ না থাকলে আনন্দ যেমন বহুলাংশে মাটি হয়ে যায়, তেমনি দুঃখও সহজে হালকা হয় না মানুষ যখন বেদনাভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তখন বন্ধুর কাছ থেকে সে প্রথম সান্ত্বনা পায়, আর যখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে তখন আনন্দের খবর সে প্রথম বন্ধুকেই জানায় বন্ধুত্বের সাথে যেহেতু আবেগের ব্যাপার জড়িত সেহেতু বন্ধুত্ব আনন্দের সাথে সাথে সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে তাই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, বন্ধুর কাছ থেকে কতটুকু চাওয়া পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে ভুল বোঝাবুঝির বা সমস্যার পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে বন্ধুত্ব কেমন হওয়া উচিত নিয়ে অনেক প্রচলিত ধারণা রয়েছে ধারণাগুলো নিয়ে আমরা যদি একটু আলোচনা করি তাহলে দেখব বাস্তবতা আসলে ভিন্ন ধারণা বাস্তবতার পার্থক্য পরিষ্কার হলে বন্ধুত্ব আরও ¯^vfvweK প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে বন্ধুত্ব সম্পর্কিত কয়েকটি প্রচলিত ধারণাকে বাস্তবতার আলোকে বিচার করলেই আমাদের কাছে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে ধারণাগুলো হচ্ছে : 
. ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একে অন্যের জীবনের সবকিছুতেই ভাগীদার হবে সাধারণভাবে ধারণা প্রচলিত হলেও আধুনিক নগরজীবনে ধারণা বাস্তবসম্মত নয় অধিকাংশের কর্মজীবনের বন্ধু এবং পারিবারিক বন্ধু ভিন্ন আবার পড়শীদের সাথে যে বন্ধুত্ব তা- আলাদা শখ বা আগ্রহের ভিত্তিতে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তা- আলাদা আবার ধর্মচর্চার বেলায় দেখা যায় সম্পূর্ণ আলাদা কারোর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব এক সম্পূর্ণ ¯^vfvweK ঘটনা কারণ মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, জীবনের সব ব্যাপারেই দুই ব্যক্তির মধ্যে আগ্রহের মিল হওয়া খুব দুর্লভ ব্যাপার এমনকি আপনার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও এমন কিছু আগ্রহ শখ থাকতে পারে যেগুলোর সাথে আপনার আগ্রহের আদৌ মিল নেই তাছাড়া সদানির্ভরযোগ্য বন্ধুত্ব কামনা, শিশুসুলভ নিরাপত্তাহীনতাবোধেরই প্রকাশ একজন বন্ধুর উপর পুরোপুরি নির্ভরতা অনেক সময়ই দুঃখের কারণ হতে পারে অপরপক্ষ তার সামাজিক পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করলেই প্রথম পক্ষকে দুঃখবোধে পেয়ে বসতে পারে তাই একক বন্ধুত্বের চেয়ে একাধিক বন্ধুত্ব সবসময়ই আবেগগতভাবে ভাল 
. সত্যিকারের বন্ধুত্ব মানে আজীবন বন্ধুত্ব ধারণা সবসময় ঠিক নয় ছোটবেলায় যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে, শিক্ষাজীবনে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে, কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তার অধিকাংশই হারিয়ে যায় আবার বাসস্থান পরিবর্তনের কারণেও পুরানো বন্ধুত্বের জায়গায় নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয় কর্মজীবী মহিলাদের বেলায় ব্যাপারটি আরও সুস্পষ্ট কর্মজীবনে বা শিক্ষাজীবনে অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়, কর্ম শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে পুরোপুরি গৃহিণী হয়ে গেলে তখন বন্ধুত্বের আওতা পুরোপুরি পাল্টে যেতে পারে তবে ধরনের খণ্ডকালীন বন্ধুত্বকেও কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করার কোন প্রয়োজন নেই জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন মানুষের সাথে প্রয়োজনীয় আনন্দদায়ক বন্ধুত্ব হতে পারে
. বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্ব সম্ভব নয় ধারণাও সবসময় সত্যি নয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিপরীত লিঙ্গের সাথে নিষ্কাম বন্ধুত্বের ঘটনাও এখন প্রায়শই দেখা যায় কোন পুরুষ নারীর মধ্যে কোন আগ্রহের বা উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে একটি সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্ভব হতে পারে মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ধরনের বন্ধুত্বকে কামবর্জিত রাখা কখনও কখনও বেশ কঠিন যখন আপনি কাউকে পছন্দ করতে শুরু করেন এবং ব্যক্তি হিসাবে তার প্রতি আকৃষ্ট হন তখন তার প্রতি যৌন অনুভূতিও সৃষ্টি হতে পারে কিন্তু এই অনুভূতি অনুসারে যে কাজ করতে হবে এমন কোন কথা নেই আপনি অনুভূতিকে মনে মনে ¯^xKvi করে নিয়েও তা সীমার মধ্যে রেখে দিলে সমস্যা না- আসতে পারে
. রক্ত পানির চেয়ে গাঢ় বন্ধুদের চেয়ে আত্মীয়রা ঘনিষ্ঠ ধারণাও সবসময় ঠিক নয় এমনও দেখা গেছে ভাইয়ের সাথে ভাইয়ের, বোনের সাথে বোনের চিন্তা-চেতনা কোন কিছুরই মিল নেই তাদের বাবা-মা এক- এছাড়া  তাদের মধ্যে আর কোন মিল পাওয়া যায় না এমনও দেখা যায়, একজনের বিপদে ভাই-বোনদের বদলে বন্ধুই এগিয়ে আসে কারণ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পছন্দের ভিত্তিতে আর আত্মীয়রা একে অন্যের সাথে রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ রক্ত পানির চেয়ে ঘন হতে পারে, কিন্তু রক্ত জমাট বেঁধে গেলে তা আঠাল হয়ে অকেজো হয়ে যায় তাই অধিকাংশ সময় দেখা যায় বন্ধুরা বন্ধুদের যেভাবে বোঝে অনুভব করে আত্মীয়রা সেভাবে বোঝেও না, অনুভবও করে না
. ভাল বন্ধুদের সমসাময়িক হতে হবে ধারণাও সবসময় ঠিক নয় ২৬ বছরের যুবকের সাথে ৫০ বছরের প্রৌঢ়ের বন্ধুত্ব হতে পারে আর বন্ধুত্ব অত্যন্ত পরিপূরক হতে পারে দুই প্রজন্মের মধ্যে বন্ধুত্ব উভয়ের জন্যে অতিরিক্ত কিছু সুযোগ এনে দিতে পারে বয়স্ক বন্ধু তরুণের জন্যে জ্ঞান, বুদ্ধি, পরামর্শের উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে আর তরুণের কাছ থেকে বয়স্ক পেতে পারে তারুণ্যের উদ্দীপনা
. বিপদে বন্ধুর পরিচয় অধিকাংশ সময়ই কথা ঠিক হতে পারে তবে কখনও কখনও ব্যতিক্রমও দেখা যায় বিপদে বা দুঃসময়ে যে বন্ধুর মত এগিয়ে আসে, অনেক সময় বিপদ কেটে গেলে বন্ধুত্বের সেই তীব্রতা থাকে না কোন কোন মনোবিজ্ঞানী বলেন, দুঃসময়ের বন্ধুত্ব সুসময়েই ভেঙে যায় কারণ সুস্থ বন্ধুত্ব দেয়া-নেয়ার উপর নির্ভরশীল বন্ধুরা পালাক্রমে উৎসাহ, উদ্দীপনা, সহানুভূতি দেয় এবং নেয় কিন্তু কোন কোন মানুষ সহানুভূতি দিতে চায়, নিতে চায় না আবার কেউ কেউ অচেতনভাবে কামনা করে বন্ধু যে ভাবাবেগজনিত সমস্যা বা দুঃসময়ে পড়েছে তা অব্যাহত থাকুক যাতে সে ক্রমাগত সহানুভূতি বিলিয়ে যেতে পারে তাই কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় বন্ধু যখন খারাপ মানসিক অবস্থা থেকে ভাল অবস্থার দিকে এগুতে শুরু করে তখন ওই ত্রাণকর্তা বন্ধুটি নিজের অজ্ঞাতসারে সুপরিবর্তনকে স্যাবোটাজ করতে চেষ্টা করে লক্ষ্য একটিই- যাতে বন্ধুত্বের ধারা অপরিবর্তনীয় থাকে
. ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বজায় রাখতে হলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে ধারণাও ঠিক নয় বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বন্ধুরা অনেক দূরে থাকে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাতের কোন সুযোগ নেই, দীর্ঘদিন পরে হয়তো দেখা হয় কিন্তু দেখা হওয়ার সাথে সাথে তাদের যে অন্তরঙ্গতার প্রকাশ ঘটে তা দেখে কেউ মনে করতে পারে যে এরা সবসময় কাছাকাছি একসাথে আছে যখন উভয়ে উভয়কে অনন্য মনে করে তখন দীর্ঘ বিচ্ছেদ সত্ত্বেও বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকে
বয়স বাড়লে নতুন বন্ধু পাওয়া যায় না ধারণাও আসলে ঠিক নয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে নতুন নতুন বন্ধুত্ব সৃষ্টি হতে পারে আবার সক্রিয় কর্মজীবন সমাপ্তির পরেও চমৎকার নতুন বন্ধুত্বের সৃষ্টি হতে পারে বন্ধুত্ব সম্পর্কে ধারণা বাস্তবতাগুলো সামনে রাখলে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাবে।