জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী, ২০১২

বাঙালী মুসলমানের মন - ১ : আহমদ ছফা

বাঙালী মুসলমানের মন - ১ : আহমদ ছফা



'শহীদে কারবালা' পুঁথিতে কবি কারবালার যুদ্ধে শহীদ হজরতের দৌহিত্র হজরত হোসেনের মস্তকসহ ঘাতক সীমারের দামেস্‌ক যাত্রা অংশটি রচনা করতে যেয়ে তাঁর কল্পনাশক্তির অবাধ ব্যবহার করেছেন। কবি বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন : কারবালা থেকে দামেস্‌ক যাচ্ছে সীমার, মনে অপার আনন্দ, এখন হজরত হোসেন বিগতজীবন, কাঁধের বর্শার অগ্রভাগে শোভা পাচ্ছে  তাঁর কর্তিত মস্তক। লক্ষ টাকা পারিতোষিক লাভ করার পথের যাবতীয় প্রতিবন্ধক অন্তর্হিত। নিশ্চয়ই বাদশাহ্‌ নামদার এজিদ তাঁর প্রতিশ্রুতি পালন করবেন। যেতে যেতে সন্ধ্যা হলো পথে। সে রাতের জন্য সীমারকে এক গৃহস্তের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হলো। গৃহকর্তার নাম পুঁথিলেখকের জবানীতে আজর। হিন্দু ধর্মালম্বী, তার ওপর আবার ব্রাহ্মণ। সেই রাতে হজরত হোসেনের ছিন্ন মস্তক এক আলৌকিক কাজ করে ফেলল। গৃহকর্তা আজর, তাঁর ব্রাহ্মণী, সাতপুত্র এবং সাত পুত্রবধূ এক সঙ্গে কাটা মস্তকের মুখে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল।

পুঁথি-পুরাণের জগতে এরকম আলৌকিক কান্ড প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। ওই জাতীয় সাহিত্যের বেশির ভাগেরই একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মের মহিমা কীর্তন করা। সেজন্য পুঁথি-পুরাণের নায়কদের চরিত্রে সম্ভব-অসম্ভব সব রকমের ক্ষমতা এবং গুণগ্রাম আরোপ করাটাই বিধি। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আধুনিক প্রোপাগান্ডা লিটারেচারের সঙ্গে পুঁথিসাহিত্যের একটা সমধর্মিতা আবিষ্কার করা খুব দুরূহ কর্ম নয়। শুধু পুঁথিসাহিত্যে কেন, 'বৌদ্ধ জাতক' থেকে শুরু করে, 'শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' এবং 'মঙ্গলকাব্য' সমূহেরও উদ্দেশ্য ছিল ঐ একই রকম। ঐ জাতীয় সাহিত্যে সচরাচর যে অবাস্তব-আলৌকিক কান্ড ঘটে থাকে, ঘেঁটে একটা তালিকা সংগ্রহ করলে ছিন্ন মস্তকের মুখে কালেমা পড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাটা খুব আশ্চর্য ঠেকবে না। পুঁথি-পুরাণের রচয়িতাদের পাল্লায় পড়ে বনের হিংস্র বাঘ, শিংঅলা হরিণ পর্যন্ত মানুষের ভাষায় কথা বলে, কাটা মাথা তো কোন্‌ ছার! সুতরাং ধরে নেয়া ভালো পুঁথি-পুরাণের জগতে জাগতিক নিয়মের পরোয়া না করে লোমহর্ষক ঘটনারাজি একের পর এক অবলীলায় ঘটে যেতে থাকবে। রোমাঞ্চকর হিন্দি ছবির দর্শকের মতো পাঠকের রুদ্ধশ্বাসে দেখে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না; সম্ভব-অসম্ভব, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। যেমন : 'লাখে লাখে সৈন্য চলে কাতারে কাতার/গণিয়া দেখিল মর্দ চল্লিশ হাজার।'  এ জাতীয় পংক্তি পাঠ করার পরেও বুদ্ধিমান সিরিয়াস মানুষের মনে কোনো জিজ্ঞাসা-চিহ্ন জাগে না। অর্থাৎ সকলেই ধরে নিয়ে থাকেন, পুঁথি-পুরাণের জগতে এ জাতীয় ঘটনা হামেশা ঘটতেই থাকবে। এ নিয়ে মনকে কষ্ট দেয়া খামোখা পন্ডশ্রম। কান্ডজ্ঞানকে ফাঁকি দেয় এ জাতীয় এন্তার ঘটনা সম্বন্ধে ওয়াকেবহাল হতে হবে, সে ব্যাপারে আগাগোড়া প্রস্তুতি গ্রহণ করেই পুঁথি-পুরাণের জগতে প্রবেশ করা উত্তম।

এরকম অভিজ্ঞতা বোধ করি অনেকেরই হয়ে থাকে। রাশি রাশি ঘটনার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনার অতি সামান্য খন্ডাংশ মুহূর্তেই ধাক্কা দিয়ে পাঠককে সচকিত করে তোলে। 'শহীদে কারবালার' বর্ণিত এই ঘটনাটিও সেই জাতীয় একটি। সীমার কারবালা থেকে দামেস্‌ক যাওয়ার পথে আজর নামধারী জনৈক ব্রাহ্মণের দেখা পেয়েছিল এবং তার বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করছিল। এই অংশটি পাঠ করার পর মনের ভেতরে একটি ঘোরতর অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই সাধারণ একান্ত বাস্তব ঘটনাটিকে পাঠকের মনের জারক রস হজম করতে পারে না। মনের তলাতে শিলাখন্ডের মতো পড়ে থাকে। তিনি যদি তার বদলে ইরাকী, তুরানী, ইহুদী, খ্রিষ্টান, তাতার, তুর্কী ইত্যাদি যে-কোন জাতির যে-কোন ধর্মের মানুষের সঙ্গে সীমারের সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতেন, তাহলে পাঠকের মনে কোন প্রশ্নই জাগত না। তিনি কারবালা থেকে দামেস্‌কে যাওয়ার পথে ধু-ধু মরুপ্রান্তরে বাঙলা দেশের ব্রাহ্মণকে আমদানী করলেন কোত্থেকে? একজন ব্রাহ্মণ কারবালা দামেস্‌কের মাঝপথে দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে কাটা মস্তকের কাছে কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য বসবাস করছিল, এইখানে মন ভয়ঙ্কর রকম বেঁকে বসে। শুধু 'শহীদে কারবালা' নয়, 'জঙ্গনামা' পুথিটার ওপর দৃষ্টি বুলোলেও এই রকম অজস্র ঘটনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। 'জঙ্গনামা'তে পুঁথিলেখক হযরত আলীকে দিয়ে কাফের ও বেদীনদের ওপর এমন চোটপাট চালিয়েছেন যে গদার আঘাতে থেতলানো, তলোয়ারের ঘায়ে কাটা পড়া কিংবা শেষ পর্যন্ত পবিত্র ইসলামের শরণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত কারো রক্ষা নেই। আমীর হামজার শৌর্যবীর্য অবলম্বন করে যে পুঁথি রচিত হয়েছে তা পড়লে লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেক চমকপ্রদ সংবাদ পাওয়া যায়। প্রায়শ দেখানো হয়েছে, মহাবীর হামজা এমন শক্তিশালী যে তিনি দেশ-দেশান্তর ঘুরে ঘুরে কাফেরদের সদলবলে পরাস্ত করছেন আর তাঁদের ঘরের সুন্দরী নারীদের পাণিপীড়ন করে চলেছেন তো চলেছেনই। কাফের এবং হিন্দু পুঁথিলেখকের কাছে অনেকটা সমার্থক। অনেক সময় কাফের বলতে হিন্দু এবং হিন্দু বলতে কাফের ধরে নিয়েছেন। সে যা হোক, আমীর হামজা এমন মস্ত বড় বীর যে তিনি দৈত্যের দেশ কো-কাফে গমন করে অপার শৌর্য বলে দৈত্যদের দমন করে বীর বিক্রমে ফিরে এসেছেন। হযরত আলীর কল্পিত পুত্র মুহম্মদ হানিফার বীরত্বগাঁথা বর্ণনা করে সোনাভান, জৈগুনবিবি ইত্যাদি যেসব পুঁথি লেখা হয়েছে বিষয়-বৈচিত্রের দিক দিয়ে সেগুলো আরও মজার। সে সকল পুঁথিতে দেখা যায় যে, মুহম্মদ হানিফা 'দুলদুল' ঘোড়ায় দুইধারী তলোয়ার ঘুরিয়ে দেশ থেকে দেশে নব অশ্বমেধযজ্ঞ করে বেড়াচ্ছেন। পথে যেসব রাজ্য পড়ছে সবগুলো নারীশাসিত। এই নারীদের সকলেই সুন্দরী; সৎ ব্রাহ্মণ-কন্যা। অবিবাহিতা এবং প্রচন্ড রকমের বীরঙ্গনা। আর সকলের এমন এক ধনুকভাঙা পণ যে, বাহুবলে যে পুরুষ হারাতে পারবে তাকে ছাড়া অন্য কারো কাছে বিয়ে বসতে মোটেই রাজী নন। মুহম্মদ হানিফা সংবাদ শুনে হাওয়ার বেগে সে দেশে দেখা দিচ্ছেন, রণংদেহি হুংকার তুলছেন। বীরঙ্গনা ব্রাহ্মণ-কন্যাদের বাহুবলে পরাস্ত করে ইসলাম ধর্ম কবুল করিয়ে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করছেন। ব্যাপারটি এতই পৌনঃপুনিকভাবে ঘটেছে যে মুহম্মদ হানিফাকে মনে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন কুলীন হিন্দু-সন্তান, বিয়ে করে বেড়ানোই তাঁর একমাত্র পেশা। মুহম্মদ হানিফা মস্ত বীর হলে কি হবে, অধিক সংখ্যক রূপসী স্ত্রীর সঙ্গে রতি-রণ এবং ময়দান-রণ দুই-ই একসঙ্গে করতে হলে মাঝে মাঝে এই সমস্ত ভয়ংকর বীরাঙ্গনাদের হাতেও নাকাল হতে হয়। সেকালে বীরাঙ্গনাদের পরাজিত করতে পারলে স্বামী আর পরাজিত হলে থাকতে হত দাস হয়ে। সুতরাং হানিফারও দুর্দশার অন্ত থাকে না। সংবাদ যায় হযরত আলীর কাছে। বীর পুত্রের এসব কীর্তিকলাপ তিনি বিলক্ষণ সমর্থন করেন; আর হৃদয়ে অপত্যস্নেহও প্রচুর। হায়দারী হাঁক হেঁকে রণ-দামাম বাজিয়ে পুত্রের সাহায্যার্থে ছুটে আসেন। পুত্রকে শিখিয়ে পড়িয়ে একেবারে লায়েক করে সে সমস্ত বিক্রমশালীদের হার মানতে বাধ্য করান। তারপর যুদ্ধকার্য সাঙ্গ হলে পিতা-পুত্র একই সঙ্গে দুটো বিবাহ করেন। পিতা যান দেশে ফিরে আর পুত্রবর প্রেমতৃষ্ণায় মাতাল হয়ে মরুভূমির ডনজুয়ানের মত নতুন নারী-রত্নের সন্ধানে দেশে দেশে সফর করেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগের বীর এবং সাধু পুরুষদের নিয়ে যে সমস্ত পুঁথিপত্র লেখা হয়েছে তাতে তাঁদের ত্যাগ, ধর্মনিষ্ঠা ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে এ জাতীয় বিস্তর আদি রসাত্মক ব্যাপার-স্যাপার স্থান লাভ করেছে। যে সকল ঐতিহাসিক চরিত্র পুঁথিলেখকরা তাঁদের বিষয়ের উপজীব্য করেছেন, তাতে করে চরিত্রের ঐতিহাসিক সত্য সম্পুর্নভাবে খেলাপ করে নিজেদের মনে রাঙিয়ে একেবারে জুবুথুবু করে হাজির করেছেন। কল্পিত চরিত্র হলে তো কথাই নেই, আগাগোড়া রঙ চড়িয়ে রঙিলা না করে ছাড়েননি। তা করতে যেয়ে পুঁথিলেখকেরা পরিবেশ, সমাজ এবং সামাজিক সংঘাত, মূল্যচেতনা দুই হাতেই দেদার ব্যবহার করেছেন।

যেমন ধরা যাক, কারবালা থেকে দামেস্‌কে যাওয়ার পথে কোনো ব্রাহ্মণের বসবাসের বিষয়টি। তা তো একেবারে জানা কথাই যে ব্রাহ্মণের সেখানে নিবাস থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু তাহলে কি হবে, পুঁথিলেখকের সেটি জানা থাকা চাই তো। কারবালা-দামেস্‌কের মাঝপথে নয়, গোটা আরবদেশে ব্রাহ্মণ না থাকুক তাতে পুঁথিলেখকের কি আসে যায়! এই বাংলাদেশে তো ব্রাহ্মণ আছে! আর আমাদের পুঁথিলেখক ভদ্রলোকটি তো বাঙালী এবং তিনি ব্রাহ্মণ জাতটার ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। সুতরাং অনায়াসে ব্রাহ্মণকে কারবালা-দামেস্‌কের মাঝপথে বসিয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ সপরিবারে তাঁকে দিয়ে কালেমা পড়িয়ে মানসিক ঘৃণার প্রতিশোধ নেয়া যায় এবং নিয়েছেনও।

ইতিহাসে হজরত আলীকে কম বিচক্ষণ বলার যথেষ্ট অবকাশ আছে। কিন্তু তিনি মানুষ হিসেবে উদার মনের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর চরিত্র এমন নির্মল সুন্দর ছিল যে এখনো পর্যন্ত তাঁর গুণগ্রাম সর্বসাধারণের অনুকরণীয় বলে বিবেচনা করা হয়। পুঁথিলেখক তাঁকে শক্তিমন্ত এবং বীর দেখাতে যেয়ে পশুশক্তিতে বলীয়ান হৃদকম্প সৃষ্টিকারী একজন প্রায় নারীলোলুপ মানুষের চিত্র অঙ্কন করেছেন।

হজরত হামজা মদীনাতে ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন এবং হিন্দা নাম্নী জনৈক কোরেশ রমণী যে তাঁর রক্তাক্ত হৃদপিন্ড চিবিয়ে খেয়েছিল একথা সর্বজনবিদিত। তিনি জীবনে মক্কা-মদীনার বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন কিনা সন্দেহ। পুঁথিলেখক তাঁকে শতাধিক বছর পরমায়ু দান করেছেন, কমপক্ষে অর্ধশত পত্নীর স্বামী, সে অনুপাতে পুত্র-পৌত্রাদি উপহার দিয়েছেন। আমির হামজা হাজার খানেক যুদ্ধে বিজয়ী বীর, দেশ-দেশান্তরে তাঁর অবারিত গতায়ত, এমনকি দৈত্যের দেশ কো-কাফে যেয়েও অসমসাহসিক কাজ সমাধা করে এসেছেন। এতেও পুঁথিলেখক তৎকালীন সমাজের প্রচলিত সংস্কার এবং শিল্পরুচির ব্যবহার করেছেন। হিন্দু সমাজের বীরেরা যদি পাতাল বিজয় করে বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারেন, আমির হামজা দৈত্যের দেশে গমন করে তাদের শায়েস্তা করে আসতে পারবেন না কেন? ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে মুহম্মদ হানিফার মূল কান্ড কিছু নেই বলেই তো সুবিধা। কল্পনা যেভাবে ইচ্ছা বিচরণ করতে পেরেছে। হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণ যদি বৃন্দাবনে ষোল শত গোপবালা নিয়ে লীলা করতে পারেন, মুহম্মদ হানিফার কি এতোই দুর্বল হওয়া উচিত যে মাত্র কয়টা ব্রাহ্মণ কন্যাকে সামলাতে পারবেন না!


এই ধরনের দো-ভাষী পুঁথিসমূহের বিষয়বস্তুর প্রতি কতিপয় বৈশিষ্ট্য পাঠকের চোখে পড়বেই। সেগুলোর মধ্যে অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য কয়েকটি হলো : প্রথমত ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করার জন্যই এই সকল কাহিনী লেখকেরা বিবৃত করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। নায়কের অসাধারন শৌর্যবীর্য এবং অসমসাহসী ক্রিয়াকলাপের অন্তরালে সত্যধর্মের বিজয়ই স্ফুরিত হচ্ছে, এটা স্বদেশবাসীর কাছে স্বদেশী ভাষায় প্রকাশ করাই বেশিরভাগ লেখকের মনোগত অভিপ্রায়। মহাভারতের বাংলা অনুবাদক যেমন বলেছেন : ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান/কাশীরাম-দাস কহে শুনে পুণ্যবান।’ তার অনুকরণ করে পুঁথিলেখকও পাঠক এবং শ্রোতাদের কাছে লোভনীয় আবেদন রেখেছেন। একটা দৃষ্টান্ত : ‘অধীন ফকির কহে কেতাবের বাত/যেবা শুনে বাড়ে তার বারেক হায়াত।’ এ জাতীয় হৃদয়-মনে উচ্চাকাঙ্খা সৃষ্টিকারী আশাব্যঞ্জক পংক্তিমালা পুঁথিগুলোর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং বিশ্বাস করতে দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে মানুষের মনে ধর্মবোধ জাগ্রত করা এবং ইসলাম ধর্মাশ্রিত মানুষের হাতে যে সাংসারিক সম্পদ, সুন্দরী নারী আপনআপনি এসে পড়ে এবং পরকালে অনন্ত সুখভোগের লীলাস্থল বেহেশত তাঁদের জন্য অবধারিত, আর শত্রুদের ওপর তাঁদের বিজয় অর্জন সে তো এক রকম স্বাভাবিকই – এ সকল বিষয় প্রমাণ করাই ছিল পুঁথিলেখকদের অধিকাংশের মনের অভিপ্রায়। দ্বিতীয়ত, এই পুঁথিসমুহের প্রতি তীক্ষ্ন বিশ্লেষনাত্মক দৃষ্টি ফেললে একটা জিনিশ বারবার চোখে পড়তে থাকে। যে সময়ে এগুলো রচিত হয়েছিল, সে সময়কার মুখ্য-গৌণ বিবদমান, বর্ধিষ্ণু-ক্ষয়িষ্ণু যে সকল সামাজিক ধারা, ধারাসমুহের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোথাও প্রচ্ছন্নভাবে, আবার কোথাও সুস্পষ্টভাবে পুঁথিসাহিত্যের ছাপ ফেলেছে। পুরনো সমাজের গর্ভ থেকে তুর্কী আক্রমণের ফলে আরেকটি নতুন সমাজ জন্মলাভ করেছে এবং সমাজের জনগণের একাংশের মধ্যে নতুন চলমানতা অর্জনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি বিকাশ করার উদ্দেশ্যেই পুঁথিলেখকেরা রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। তার ফলে তাদের মনেও নতুন এক ধরণের জনপ্রিয় বীরশ্রেণী জন্মলাভ করতে আরম্ভ করে। পুরনো সমাজের যে সকল নায়ক, খলনায়ক – রামচন্দ্র, লক্ষণ, সীতা, রাবণ, ভীম, অর্জুন, হনুমান, কর্ণ, ভীস্ম, দ্রোণ, শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা, দ্রৌপদী ইত্যাদির কাহিনীতে ধর্মীয় এবং সামাজিক কারণে মুসলমান সমাজ মনোনিবেশ করতে রাজী ছিল না। এই নতুন সমাজের নিজস্ব নায়ক চাই, চাই নিজস্ব বীর। যাঁদের জীবনকথা আলোচনা করে দুখেঃ সান্ত্বনা, বিপদে ভরসা পাওয়া যায়, যাঁরা তাদের আপনজন হবেন এবং একটি আদর্শায়িত উন্নত জীবনের বোধ সৃষ্টি করতে পারবেন। এই সকল কারণের দরুণ হযরত মুহম্মদ, হযরত আলী, বিবি ফাতেমা, হাসান-হোসেন, বীর হানিফা, আমির হামজা, হাতেমতাই, রুস্তম ইত্যাদি চরিত্র বাংলা সাহিত্যে নবজন্ম লাভ করে। তাঁদের জন্ম-প্রক্রিয়ার মধ্যে দুটি মুখ্য বিষয় মিলমিশ খেয়েছে। এই ঐতিহাসিক মহামানবদের যে সকল কীর্তি-কাহিনী লোকশ্রুতি-জনশ্রুতির আকারে তাঁদের কাছে এসে পৌঁছেছে (পুঁথিলেখকদের অধিকাংশই আরবী ফার্সী জানতেন না এবং ইসলামী শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন না) তার সঙ্গে মহামানব এবং সামাজিক নায়কদের সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা তৎকালীন সমাজে বলবৎ ছিল তার সংশ্লেষ ঘটেছে। তাই ইসলামের দিকপালদের নিয়ে রচিত পুঁথিসাহিত্যে যেমন চরিত্রের ঐতিহাসিকতা পাওয়া যাবে না, তেমনি বাঙালী সমাজের প্রচলিত বীরদের সম্বন্ধে যে ছকবাঁধা ধারণা বর্তমান ছিল তাও পুরোপুরি উঠে আসেনি। দুটি মিলে একটি তৃতীয় বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। আসলে পুঁথি সাহিত্য হলো দুটি পাশাপাশি সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক আদর্শের ঘাত-প্রতিঘাতে মুসলমান জনগণ যেভাবে সাড়া দিয়েছে তারই প্রতিফলন। মুসলমান জনগণের মতো হিন্দু জনগণও আরেক রকমভাবে এই সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিয়েছেন, মঙ্গলকাব্যসমূহ এবং বৈষ্ণব সাহিত্যে ঘটেছে তার প্রকাশ।

এই নবসৃষ্ট সাহিত্যকর্ম সমূহের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে নূতন সামাজিক চাহিদার জবাব রয়েছে। জনগণ যে ধরণের রসালো কাহিনী শুনতে আগ্রহী সে ধরণের কাহিনীই লেখকেরা পরিবেশন করেছেন। মুসলমান এবং হিন্দু সাহিত্যস্রষ্টারা আপনাপন সমাজের দিকে লক্ষ্য রেখেই সৃষ্টিকর্মে মনোনিবেশ করেছেন। মুসলমানদের তুলনায় হিন্দু কবিদের অনেকগুলো সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুযুগ বিদ্যমান ছিল। প্রথমত আক্রমণমুখী বর্ধিষ্ণু মুসলমান সমাজের সঙ্গে সংঘাতে হিন্দু সমাজের তলা পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। আত্মরক্ষার প্রয়োজনটাই তাঁদের কাছে বড় কথা। হিন্দু কবিরা এই সামাজিক ভীতির সঙ্গে একাত্মবোধ প্রকাশ না করে পারেননি। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে যখনই কোনো নতুন সামাজিক পরিবর্তন এবং নবতর মূল্যচেতনা সমাজের অভ্যন্তর থেকে সূচিত হয়েছে, তার প্রাণবস্তুটি সাহিত্য-স্রষ্টাদের কন্ঠে আপনা থেকেই কথা কয়ে উঠেছে। আর মুসলমান শাসনামলে হিন্দু সমাজের যে সামাজিক রূপান্তর ঘটছিল তাতে সংস্কৃতিগত ব্যবধান ছিল না, নিজেদের সংস্কৃতিকে নিজেদের প্রয়োজনে নতুনভাবে রূপদান করছিল। যেখানে বিষয় এবং বিষয়ীর সঙ্গে দুরত্ব বা বিরোধ নেই। সমাজের পূর্বার্জিত সামাজিক অভিজ্ঞতাসমূহকে পূর্ণবিশ্বাসে আত্ম-প্রত্যয়ের সঙ্গে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। মুসলমান পুঁথিলেখকদের তুলনায় হিন্দু কবিদের রচিত সাহিত্যকর্মে যে অধিক মানসিক পরিশ্রুত, পঠনপারিপাট্য এবং কান্ডজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়, তার কারণ তাঁদের সম্পুর্ন অজানা একটি বিষয়ের প্রতি ধাবিত হতে হয়নি।

তুলনামুলক বিচারে মুসলমান পুঁথিলেখকদের হাতে সে পরিমাণ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধা ছিল না। প্রথমত তাঁদেরকে সম্পুর্ন অজানা একটি বিষয়কে প্রকাশ করতে হয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আসল স্বরূপ, তার দার্শনিক প্রতীতি ইত্যাদি সম্বন্ধে মুসলমানদের আরবী-ফার্সীতে লেখা গ্রন্থসমূহ বদলে লোকশ্রুতি এবং দুরকল্পনার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।  একথাও সত্য যে পুঁথিলেখকদের অধিকাংশেরই আরবী-ফার্সী সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না। তাছাড়া হিন্দুদের দেব-দেবী এবং কাব্যোক্ত নায়ক-নায়িকাদের প্রতি মনে মনে একটি বিদ্বেষের দুরস্মৃতিও সক্রিয় ছিল। কেননা এই দেব-দেবীর পূজারীদের অত্যাচার এবং ঘৃণা থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় তাঁদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে বৌদ্ধ এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাই মুসলমান পুঁথিলেখকেরা তাঁদের রচনায় যখনই সুযোগ পেয়েছেন, এই দেব-দেবীর প্রতি তাচ্ছিল্য এবং ঘৃণা প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও হিন্দু সমাজের দেব-দেবী, নায়ক-নায়িকার প্রভাব থেকে তাঁদের মন মুক্ত হতে পারেনি। তাই তারা সচেতনভাবে এই দেব-দেবীর প্রতিস্পর্ধী নায়ক এবং চরিত্র যখন খাড়া করেছেন, এই সৃষ্ট চরিত্র সমূহের মধ্যেই দেব-দেবী নতুনভাবে প্রাণ পেয়েছে। হজরত মুহম্মদ, হজরত আলী, আমির হামজা, মুহম্মদ হানিফা, বিবি ফাতেমা, জৈগুন বিবি এই চরিত্রসমূহ বিশ্বাসে এবং আচরণে, স্বভাবে-চরিত্রে যতদূর আরব দেশীয়, তার চাইতে বেশি এদেশীয়। তাঁদের মধ্যে যে বুদ্ধিমত্তা এবং হৃদয়াবেগ কাব্যলেখক চাপিয়ে দিয়েছেন তা একান্তভাবেই বঙ্গদেশে প্রচলিত দেব-দেবীর অনুরূপ। বাইরের দিক থেকে দেখলে হয়তো অতোটা মনে হবে না। কিন্তু গভীরে দৃষ্টিক্ষেপ করলে তা ধরা না পড়ে যায় না। বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতা সাহিত্যের দুই মুখ্য উপাদান। বিশ্বাস অভিজ্ঞতার নবরূপায়ণে সাহায্য করে। আলোকিত বিশ্বাস আলোকিত রূপায়ণ ঘটায় এবং অন্ধবিশ্বাস অন্ধ রূপায়ণ। মুসলমান পুঁথিলেখকদের বিশ্বাসের যে শক্তি তা অনেকটা অন্ধবিশ্বাস, কেননা ইসলামী জীবনবোধসমৃদ্ধ বিমূর্ত কোন ধারণা তাঁদের ছিল না। তাই তাদের শিল্পকর্ম অতটা অকেলাসিত। প্রতি পদে কল্পনা হোঁচট খেয়েছে বলে তাঁদের রচনার শক্তি নেই। আলাওল, দৌলত উজীর প্রমুখ মুসলাম কবি উৎকৃষ্ট কাব্যরচনা করতে পেরেছেন। তার কারণ তাঁদের কতিপয় সুযুগ ছিল। আলাওল নিজে আরবী, ফার্সী এবং সংস্কৃত সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। কাব্যের স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা সম্বন্ধে তাঁর পরিপূর্ণ বোধ ছিল। তদুপরি তিনি রাজসভায় বসে কাব্য রচনা করেছিলেন। রাজসভায় যে রুচিচর্চা এবং জীবনাদর্শের আলোচনা চলতে পারে, জনসভাতে তা চলে না। একই কথা দৌলত উজীর সম্বন্ধেও কম-বেশি প্রযোজ্য।

কিন্তু যে সকল মুসলমান কবিকে জনগণের ধর্মবোধ পরিতৃপ্ত এবং রক্তপিপাসা মিটাবার জন্য কলম ধরতে হয়েছিল, সেখানে কবি কী বলতে চান, কাদের জন্য বলতে চান এবং যা বলছেন তা অনুধাবনযোগ্য কিনা এইসব বিবেচনার বিষয় ছিল।


মুসলমান সমাজের কোন্‌ অংশের সামাজিক চাহিদা পূরণ করার জন্য এই পুঁথিসমূহ লেখা হয়েছিল এবং কারা লিখেছিলেন, তাঁদের বিদ্যাবত্তা এবং সংস্কৃতিক অগ্রগতি কতদূর ছিল - তলিয়ে বিচার করলে কতিপয় বিষয় স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। মূলত বাঙালী সমাজের যে শ্রেণীটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং নতুন ধর্ম গ্রহণ করার কারণে, অধিকতর খোলাসা করে বলতে গেলে মুসলিম রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দরুণ, তাঁদের মধ্যে নতুন আকাঙ্খার উন্মেষ ঘটেছিল, সেই শ্রেণীটিই ছিল পুঁথিসাহিত্যের আদর সীমাবদ্ধ। তাঁরাই এর লেখক, পাঠক এবং সমাঝদার। তাছাড়া রোসাং ইত্যাদি রাজদরবারে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের যে চর্চা হয়েছে, তাতে যে সকল মুসলিম কবি-সাহিত্যিক আশাতিরিক্ত সাফল্য প্রদর্শন করেছেন, জনগণের দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে তার সংযোগ খুব নিবিড় কিংবা গভীর ছিল না। রাজসভার বিদ্যাবত্তা, মার্জিত রুচি, বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরনই অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলাওল প্রমুখ শক্তিমন্ত কবির কাব্য-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। আর কবিরাও ছিলেন বহুদর্শী পন্ডিত। আরবী, ফার্সী এবং সংস্কৃতি ভাষাতে ছিলেন সমান পারদর্শী। তাঁদের সাধনার মধ্যে কাব্যের ঔচিত্যবোধ জখম হয়নি বটে, কিন্তু জনগণের জীবনধারার সমতলে এসে চাহিদামতো কাব্যরচনাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। জনগণের সঙ্গে অনেকটা সম্পর্কহীন জ্যোৎস্নাভুক সৌন্দর্যবিলাসী ছিলেন বলেই তাঁদেরকে কাব্যের সামাজিক আদর্শ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে হয়নি। আরবী-ফার্সী থেকে যে কোনো কাহিনী অনুবাদ করে রসসমৃদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতে পারলেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যেত এবং তাঁদের সে যোগ্যতায় ঘাটতি ছিল না।

দো-ভাষী পুঁথিলেখকদের সমস্যা ছিল ভিন্নরকম। তাঁরা ছিলেন একই সঙ্গে জনগণের শিল্পী এবং শিক্ষক। পুঁথিসমূহের অনেকগুলো রচনার পিছনে সক্রিয় ছিল সামাজিক প্রয়োজন। এই প্রয়োজন পূর্ণভাবে পালন করার জন্য তিনটি উপাদান অপরিহার্যভাবে প্রয়োজনীয় ছিল। যে সামাজিক আদর্শটি তাঁরা প্রচার করতে যাচ্ছিলেন সে সম্বন্ধে সম্মক ধারণা এবং উপলব্ধি। যে সমাজে এই আদর্শ প্রচার করেছিলেন সেই বিশেষ সমাজটির লোক-সাধারণের সাংস্কৃতিক চেতনার মান; বিমূর্তভাবে নতুন সামাজিক আদর্শ ধারণ করার মতো মানসিক সাবালকত্ব অর্জন করেছে কিনা সে সম্বন্ধে একটা প্রাক-ধারণা এবং পূর্বের শিল্পাদর্শের অগ্রসর ধারাটির বিষয়ে তাঁদের উপযুক্ত জ্ঞান আর সেই ধারাটিকে সামাজিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে সম্পুর্ন নতুন একটি খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতা ছিল কিনা। এই তিনটি মৌল বিষয়ের কোনোটিই পর্যাপ্ত পরিমাণে পুঁথিলেখকদের সপক্ষে ছিল না। সামাজিক বীর এবং নায়ক সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের মহিমা কীর্তন করার উদ্দেশ্যেই তাঁদের বেশিরভাগ কাব্যসাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞান কিছু লোকশ্রুতি, জনশ্রুতি, আউলিয়া দরবেশদের অলৌকিক ক্রিয়াকান্ড ইত্যাদির মধ্যেই সীমিত ছিল। আরবী-ফার্সী ভাষায় দখলের অভাবে অধিকাংশের ইসলাম বলতে একটা পাঁচমিশেলী ঝাপসা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাঁদের রচিত সাহিত্যে সেই ধারণারই অভিব্যক্তি ঘটেছে। তাছাড়া যে সমাজের লোক-সাধারণের কাছে নতুন ধর্মের সারল্য এবং সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করছিলেন, সেই সমাজটির মানসিক পরিসর অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং সঙ্কুচিত ছিল। কেননা নিম্নবর্ণের অধিকাংশ হিন্দুই যুগ যুগ ধরে আর্থিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিপীড়িত হওয়ার ফলে মুক্তির আশায় প্রথমে বৌদ্ধ এবং পরে ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। নতুন ধর্ম গ্রহণ ছিল একটি নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর আত্মরক্ষার অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত একটা ব্যবহারিক পদক্ষেপ। সুতরাং পূর্ববর্তী সমাজেও যে গরীয়ান একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল, তাঁরা তার মর্মমধু পান করা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। আবার ইসলামী সমাজ এবং সংস্কৃতির যে একটা উন্নত উদার আদর্শ ছিল ঐতিহাসিক কারণে তাও তাঁরা অধিগত করতে পারেননি। এই অনগ্রসর জনসমাজ ইসলামের নামে যে সকল কাহিনী চাইতেন, সেই রকম কাহিনীই তাঁদের শোনাতে হত। আর পুঁথিলেখকরা ছিলেন এই জনগণেরই কন্ঠ।

এই সকল কারণে বাঙালী মুসলমান রচিত পুঁথিসাহিত্য উদ্ভট রসের অতি বেশি ছড়াছড়ি। হিন্দু মহাকাব্য এবং পুরাণসমূহের বীর-বীরাঙ্গনাদের চরিত্রের অপ্রভংশ মুসলিম কবিদের সৃষ্ট বীরদের মধ্যে নতুন করে জীবনলাভ করেছে। তাই পুঁথিসাহিত্যে অগ্রসরমানতার চাইতে প্রতিক্রিয়ার জের অধিক। মনের হীনম্মন্যতাবোধ থেকেই এই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি। এর পেছনে একগুচ্ছ ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান। মুসলমান পুঁথিলেখকেরা সচেতনভাবে এক সামাজিক আদর্শ, একটি শিল্পাদর্শের বদলে আরেকটি শিল্পাদর্শের নির্মাণের প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু নতুন শিল্পাদর্শটির চেহারা কিরকম হবে, জীবনের কোন্‌ মূল্যচেতনার বাহন হবে, অতীতের কতদুর গ্রহণ করবে, কতদুর বর্জন করবে, সে সম্বন্ধে তাঁদের মনে কোনো পরিচ্ছন্ন ধারণা ছিল না। তাই তাঁরা অনেক সময় বহিরঙ্গের দিক দিয়ে নতুন সৃষ্টি করলেও, আসলে তা ছিল গলিত অতীতের রকমফের। উপলব্ধির বদলে বিক্ষোভ, পরিচ্ছন্ন চিন্তার বদলে ভাবাবেগই তাঁদের শিল্পদৃষ্টিকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এক সময়ে এই মুসলমানের পূর্বপুরুষেরা যে উঁচু বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন, এই অপমানজনক দুরস্মৃতি বাইবেলের 'অরিজিনাল সীন' বা আদি পাপের ধারণার মতো তাঁদের মনে নিরন্তর জাগরুক থেকেছে। মুসলমান রচিত পুঁথি-সাহিত্যের প্রতিক্রিয়াশীলতা আসলে সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীলতারই সাহিত্যিক রূপায়ণ। সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা পোষণ করতে হলে এই অপমানজনক দুরস্মৃতির বিষয়টি স্মরণে রাখার প্রয়োজন আছে। মুসলিম শাসনের অবসানের পর এই সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরো গভীর এবং অন্তর্মুখী রূপ পরিগ্রহণ করে। এই প্রতিক্রিয়ার জের বাঙালী মুসলমান সমাজে এত সুদুরপ্রসারী হয়েছে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী গদ্য-লেখক মীর মশাররফ হোসেনের সুবিখ্যাত 'বিষাদ সিন্ধু' গ্রন্থটিতেও 'শহীদে কারবালা' পুঁথির ব্রাহ্মণ আজরকে একই চেহারায়, একই পোশাকে, একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সময়ের পালাবদলের ব্যাপারটি এই অত্যন্ত শক্তিধর লেখকের মনে সামান্যতম আঁচড়ও কাটতে পারেনি। পুঁথিলেখকের কান্ডজ্ঞানহীনতাকে তিনিও বরণ করে নিয়েছেন।


যেহেতু নবদীক্ষিত মুসলমানদের বেশিরভাগই ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু, তাই আর্য সংস্কৃতিরও যে একটা বিশ্বদৃষ্টি এবং জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যে একটা প্রসারিত বোধ ছিল, বর্ণাশ্রম ধর্মের কড়াকড়ির দরুণ ইসলাম কিংবা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে সে সম্বন্ধে তাঁদের মনে কোনো ধারণা জন্মাতে পারেনি। পাশাপাশি ইসলামও যে একটা উন্নততর দীপ্ত ধারার সভ্যতা এবং মহীয়ান সংস্কৃতির বাহন হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে একটা সামাজিক বিপ্লব সংসাধন করেছিল, বাঙালী মুসলমানের মনে তার কোনো গভীরাশ্রয়ী প্রাভাবও পড়েনি বললেই চলে। প্রথমত, ভারতে ইসলাম প্রচারে মধ্যপ্রাচ্যের সুফী দরবেশদের একটা গৌণ ভূমিকা ছিল বটে, কিন্তু লোদী, খিলজী এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্য বিস্তারই ইসলাম ধর্মের প্রসারের যে মূখ্য কারণ, তাতে কোনো সংশয় নেই। এই পাঠান-মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক একবস্তু ছিল না। আব্বাসীর খলীফাদের আমলে বাগদাদে, ফাতেমীয় খলীফাদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলীফাদের স্পেনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল, ভারতবর্ষে তা কোনোদিন প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের যে অপ্রতিহত প্রভাব ইউরোপীয় রেনেসাঁকে সদ্ভাবিত করে তুলেছিল, ভারতের মাটিতে সে যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা একেবারেই শিকর বিস্তার করতে পারেনি। খাওয়া-দাওয়া, সঙ্গীতকলা, স্থাপত্যশিল্প, উদ্যান রচনা এবং ইরান, তুর্কীস্থান ইত্যাদি দেশের শাসনপদ্ধতি এবং দরবারী আদব-কায়দা ছাড়া অন্য কিছু ভারতবর্ষ গ্রহণ করেনি।

তদুপরি, এই ভারতবর্ষের লক্ষ্নৌ, দিল্লী ইত্যাদি অঞ্চলে ইসলামের যেটুকু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে, বাঙলা মুলুকে তার ছিটেফোঁটাও পৌছাতে পারেনি। যে মুসলিম শাসকশ্রেণীটি নানা সময়ে বাঙলা দেশ শাসন করতেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন বিদেশী। রক্ত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। অনেকটা ইউরোপীয় শাসকদের মতো সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই তাঁরা বসবাস করতেন এবং নতুন পোশাক-আশাক, ফ্যাশান ইত্যাদির জন্য দিল্লী কিংবা ইরানের দিকে সাগ্রহে তাকিয়ে থাকতেন। এই উঁচুকোটির মুসলিম শাসকবর্গ যাঁদের হাতে অধিকাংশ শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব অর্পিত ছিল, তাঁরা স্থানীয় জনগণের স্বাভাবিক নেতা ছিলেন না। এই উঁচুকোটির মুসলমান প্রশাসকেরা এদেশীয় যে শ্রেণীটির সহায়তায় বাঙলা দেশে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন স্থানীয় উঁচু বর্ণের বাঙালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈদ্য শ্রেণীর লোক। যখনই প্রয়োজন পড়েছে কিংবা ব্রাহ্মণ শ্রেণীর আনুগত্য সম্বন্ধে মনে সন্দেহ জেগেছে তাঁরা অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে খেলাত এবং পদবী বিতরণ করে আরেকটি নেতৃশ্রেণী সৃষ্টি করেছেন। 'খাসনবীস', 'মহলানবীস', 'দেওয়ান', 'রায়রায়ান', 'বখসী', 'মুন্সী', 'দস্তিদার' ইত্যাদি পদবীতেই তার প্রমাণ মেলে। বাঙলার স্থানীয় মুসলমানেরা কদাচিৎ বিদেশী মুসলমান শাসকদের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক কর্মে সহায়তা করার সুযোগ লাভ করেছেন। তার কারণ ছিল, একটি রাজশক্তির সঙ্গে সহায়তা করার জন্য যে পরিমাণ নিরাপদ আর্থিক ভিত্তির প্রয়োজন বাঙালী মুসলমানদের তা ছিল না। মুসলিম রাজশক্তি এই দেশের সমাজ-কাঠামোর মধ্যে অতি সামান্যই রূপান্তর এনেছিল। তাঁরা অনেকটা নির্বিবাদেই পূর্বতন সমাজ-কাঠামোকে গ্রহণ করেছিল। পরিবর্তন ততটুকুই করেছিল, যতটুকু তাঁদের প্রয়োজন। অর্থাৎ পূর্বেকার শাসক নেতৃশ্রেণীর শূণ্যস্থানটিই তাঁরা পূর্ণ করেছিলেন। মুসলিম শাসনের পূর্বে যে সমাজব্যবস্থাটি চালু ছিল, পরেও সেই একই সমাজব্যবস্থা চালু থেকেছে। তার মধ্যে কোনো মৌলিক রূপান্তর বা পরিবর্তন তাঁরা আনতে পারেননি। তাই নতুন ধর্ম গ্রহণ করার পরেও স্থানীয় মুসলমানরা ইংরেজ আমলের দিশী খৃষ্টানদের মতো একটা উন্মত্ত গর্ববোধ ছাড়া ইসলামী কিংবা আর্য সংস্কৃতির কিছুই লাভ করতে পারেননি। তাই খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, মুসলমান আমলেও যাঁরা শাসনতান্ত্রিক প্রয়োজনে ফার্সী ভাষা শিক্ষা করেছেন, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের উঁচু বর্ণের লোক। বাঙালী মুসলমাদের অবস্থার, পেশার এবং রুচির বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। ইসলাম গ্রহণের ফলে তাঁরা কতিপয় মোটা অভ্যাস বর্জন করে কতিপয় মোটা অভ্যাসকে গ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু সংখ্যাগত দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন অনেক, উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত ছিলেন এবং রাজশক্তি সময়ে-অসময়ে তাঁদের প্রতি আনুকুল্য প্রদর্শন করতেন, এই সকল কারণের দরুণ তাঁদের মধ্যে দ্রুত একটা সামাজিক আকাঙ্খা জন্মলাভ করেছিল। পুঁথিসাহিত্যের মধ্যে এই আকাঙ্খাই পূর্ণ দৈর্ঘ্যে মুক্তিলাভ করেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন