জনপ্রিয় পোস্টসমূহ

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সম্পর্ক, সম্পর্কবোধ, সম্পর্কের দায়

জীবনের অন্য নাম সম্পর্ক। কিংবা সম্পর্ক মানেই জীবন- বলা যায় এভাবেও। নানা ধরনের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবন কাটায় মানুষ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী-সহমর্মী এবং এই ধরনের আরও অনেক মানবিক সম্পর্ক প্রায় নিয়তি-নির্ধারিত ভূমিকা পালন করে মানুষের জীবনে। শুধু কি তাই? সম্পর্ক স্থাপিত হয় জড় জগতের সঙ্গেও। যে প্রিয় কলমটি দিয়ে আমি লিখি তার সঙ্গেও কি একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমার? নইলে ওটা ছাড়া লিখতে আমি অস্বস্তি বোধ করি কেন? খাবার টেবিলে সবসময় কেন একটি নির্দিষ্ট চেয়ারেই বসি অন্য সব চেয়ার খালি থাকলেও! এমন তো নয় যে, ওই চেয়ারটিই আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কেউ! যে কাপটিতে আমি চা খাই, যে গ্লাসটিতে পানি, যে প্লেটে ভাত, ঘুমানোর সময় যে বালিশটি মাথায় দেই, যে ঘড়িটি হাতে পড়ি, যে দোকান থেকে সিগারেট কিনি _ এসবকিছুর সঙ্গেই একটি সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে আমার। কিংবা এভাবে কি বলবো যে, এগুলোর সঙ্গে আমার এক ধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে? আর সেজন্যই এর যে কোনোকিছুর অনুপস্থিতি বা ব্যতিক্রম আমার মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করে! সম্পর্কের অন্য নাম কি তবে অভ্যাস? জীবন মানে সম্পর্ক আর সম্পর্ক মানে অভ্যাস! জীবন কি তাহলে নানারকম অভ্যাসেরই প্র্যাকটিস? তা যদি হয়ও, তবু তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকে।

অফিসে আমার টেবিলের কাঁচটি ভাঙা। দীর্ঘদিন ধরেই ভাঙা। আমি বদলাই না। বললেই হয়ে যায়, ঐ সুসজ্জিত অফিসে ওই ভাঙা কাঁচটি বেশ বেমানান এবং দৃষ্টিকটুও বটে। তবু আমি সেটা বদলাই না কেন? বদলাই না, কারণ ঐ গর্জিয়াস প্রতিষ্ঠানে ভাঙা কাঁচটি যেমন বেমানান, ম্লান, মিসফিট- আমিও তেমনই ওখানে বেমানান, ম্লান, মিসফিট। যেন উভয়ে মিলে প্রতিষ্ঠানটির আভিজাত্যকে মুখ ব্যাদান করে উপহাস করে যাচ্ছি।

ভাঙা কাঁচটির সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাই আমি, ওটার জন্য মায়া জন্মে গেছে আমার- ওটাকে তাই বদলাতে পারি না।
একবার খুব পুরনো একটা গ্লাস ভেঙে যাওয়ায় মাকে রীতিমতো কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। ওই গ্লাসের দাম এমন কিছু বেশি ছিলো না, আর মা নিশ্চয়ই দামের কথা ভেবে কাঁদেওনি। নিশ্চয়ই ওটার সঙ্গে মায়ের অনেক স্মৃতি ছিলো। আর এই স্মৃতিই তৈরি করেছিলো সম্পর্ক।

বস্তুজগতের সঙ্গে এভাবেই হয়তো সম্পর্ক তৈরি হয় মানুষের।

২.
মানুষের অনেকগুলো সম্পর্ক নিয়তি-নির্ধারিত বা প্রকৃতি প্রদত্ত। মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্নীয়স্বজন ছাড়াও যে দেশটিতে যে সমাজে যে সময়কালে সে জন্মগ্রহণ করে, এর কোনোকিছুই সে নিজে বেছে নেয় না। প্রকৃতি তাকে এই সম্পর্কগুলো উপহার দেয়। সে এগুলো মূল্যবান মনে করুক আর না করুক, এমনকি এগুলো তার কাছে বোঝা হয়ে উঠলেও তার কিছু করার নেই, কারণ প্রকৃতিপ্রদত্ত কোনোকিছুকে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করা যায় না। একজন মানুষ বড়জোর এগুলো থেকে পালিয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে পারে- এসকেপিস্টরা সেটাই করে, কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিংবা কে জানে, প্রকৃতি প্রদত্ত বলে, সহজে পাওয়া গেছে বলে মানুষের কাছে এগুলোর মূল্য কম- মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এই যে, সে কিছু না কিছু অর্জন করতে চায়, অর্জনে যে আনন্দ, সহজপ্রাপ্তিতে সেই আনন্দ নেই বলেই। আর তাই মানুষ এইসব সম্পর্কেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না। সারাজীবন ধরে সে নানারকম সম্পর্ক নির্মাণ করে যায়, এমনকি ঘটনাক্রমেও সে অনেক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মানুষের উদ্ভাবিত শ্রেষ্ঠ দুটো সম্পর্কের নাম- প্রেম ও বন্ধুত্ব। অবশ্য প্রেম শব্দটি দিয়েই সব সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করা যায়। তা কাদের সঙ্গে প্রেম হয় অথবা বন্ধুত্ব? একজন মানুষ আরও হাজার মানুষ থাকতে কেন একজন নির্দিষ্ট মানুষের সঙ্গে এরকম সম্পর্ক গড়ে তোলে? আমার মনে হয় মানুষ আসলে তার প্রেমেই পড়ে যার মধ্যে সে নিজেকে প্রকাশিত হতে দেখে।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়- সারাজীবন ধরে মানুষ অন্যের চোখে নিজেকে দেখে নিতে চায়। তার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন হয় এই একটি জিনিসকে কেন্দ্র করেই। একটি সুন্দর শার্ট আমি পড়ি কেন? পড়ি আমাকে সুন্দর লাগবে বলে। কিন্তু সুন্দর না লাগলে অসুবিধা কোথায়? লাগলেই বা সুবিধাটি কি? কি যায় আসে এই সুন্দর লাগা না লাগায়? যায় আসে। আমি চাই অন্যের চোখ থেকে আমার প্রশংসা ঝড়ে পড়ুক। আমি যে সুন্দর সেটা যদি জানাও থাকে আমার তা যেন যথেষ্ঠ নয়, আমি অন্যের চোখে নিজেকে দেখে নিতে চাই। অন্যের চোখ থেকে প্রশংসা ঝরে না পড়লে আমার সমস্ত সৌন্দর্যই ম্লান ও ব্যর্থ হয়ে যায়। একটি চায়ের কাপ কেনার সময় কেন সবচেয়ে সুন্দর সেটটিই কিনতে চাই আমি? কারণ যে অতিথিকে আমি সেই কাপে চা দেব, তার কাছ থেকে যেন আমি আমার রুচির প্রশংসা শুনতে পাই। মানুষ এমনই- নিজেই অজান্তেই সে নিজেকে কেন্দ্র করে ঘোরে।

প্রেমও তাই। আমি তাকেই চাই, তারই প্রেমে পড়ি যার মধ্যে আমার পছন্দের বিষয়গুলো আছে, যার চোখে তাকালে আমি নিজেকে দেখতে পাই।

৩.
প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়ে যায়- এটা খুবই প্রচলিত কথা। কেন এটা বলে সবাই? তার কারণ কি এই যে, প্রেমে পড়লে প্রেমিকটি এমন সব আচরণ করে যা তাকে মানায় না, যা তার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না! সম্ভবত তাই। কিন্তু কেনই বা সে এমন আচরণ করে? করে _ কারণ তখন সে ইনোসেন্ট হয়ে যায়। প্রেম যত গভীর তত বেশি আবেগময় এবং বেহিসেবি- আর প্রেমে পড়া মানুষটি তত বেশি ইনোসেন্ট। কোথায় যেন পড়েছিলাম _ সারাটি জীবন মানুষ যে তার শৈশবে ফিরতে চায় তার কারণ- তার ভেতরে থাকে সরলতার কাছে ফেরার আকাঙ্ক্ষা, থাকে ইনোসেন্ট হবার আকাঙ্ক্ষা। শৈশব মানেই তো সারল্য, নিস্পাপতা আর সহজতা। বয়স যত বাড়ে ততই বাড়ে জটিলতা, বাড়ে ভার- জীবন ক্রমশ জটিল আর ভারি হয়ে ওঠে, মানুষ পরিণত হয় ভারবাহী প্রাণীতে। জটিলতায় আক্রান্ত মানুষ তাই শৈশবে ফিরতে চায়, সেখানে সে এক অসামান্য সরলতার কাছে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু চাইলেই কি ফেরা যায় শৈশবে? যায় না। আর প্রেম সেখানেই পালন করে দারুণ কার্যকরী ভূমিকা। প্রেম মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশব- কৈশোরের সরলতায়, সহজতায়, নিস্পাপতায়।

কিন্তু এমন প্রেম কোথায় পাওয়া যায়? এখন, এই বস্তুবাদী সময়ে প্রেম মানেই হিসেব-নিকেশ, বিয়ে, সংসার, সম্পত্তি, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব হিসেব নিকেশের মধ্যে প্রেম পালাবার পথ পায় না। জীবনের অন্যান্য জটিলতার মতোই প্রেম দেখা দেয় এক ভয়ংকর জটিলতা হিসেবে। সেখানে আর আবেগ থাকেনা, থাকে না উদ্দামতা, উচ্ছ্বলতা, আনন্দ- মাথা জাগিয়ে থাকে কেবলই হিসেব নিকেশ। সমাজের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুজন মানুষ আর পাশাপাশি হাঁটবার প্রেরণা পায় না নিজের ভেতরেই।

৪.
সব সম্পর্ককেই মানুষ কোনো না কোনো নাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। সম্পর্কের বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাস নেই তার, নেই আস্থাও, কিংবা বহুমাত্রিক সম্পর্কের বিষয়টি সে বোঝেই না। ফলে একটি নাম না দিলে সে অস্বস্তিতে ভোগে, অশান্তিতে ভোগে। কিন্তু যখনই একটি সম্পর্কের নাম দেয়া হয় তখনই তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়, সেই সম্পর্কে নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়। সম্পর্ক হয়ে পড়ে স্থির, বদ্ধ।

অথচ সম্পর্ক বিষয়টিই পরিবর্তনশীল, বিবর্তনশীল। এক জায়গার দাঁড়িয়ে থাকার জিনিস নয় এটা। সম্পর্ক ক্রমাগত তার ধরন পাল্টায়, তার স্বভাব পাল্টায়- যদি না পাল্টায় তবে তা পরিণত হয় অভ্যাসে। সম্পর্কের সঙ্গে অভ্যাসের পার্থক্যটা এখানেই। সম্পর্ক বিবর্তনশীল, পরিবর্তনকামী, নতুন মাত্রা যোগের সম্ভাবনাপূর্ণ, আর অভ্যাস স্থির, পরিবর্তনহীন, একঘেঁয়েমিপূর্ণ।

মানুষ যে সম্পর্কের একটি নাম দিতে চায় তার কারণটি হয়তো এই যে, সে সম্পর্কের একমাত্রায় বিশ্বাস করে, স্বস্তি পায়- সম্পর্কটিকে একটি মীমাংসায় পেঁৗছে দিতে চায়, একটি সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলতে চায়।

অথচ অমীমাংসিত সম্পর্কই সুন্দর, যদিও তা বেদনাদায়ক। অসংজ্ঞায়িত সম্পর্কই সম্ভাবনাপূর্ণ, যদিও তা বহন করা কষ্টকর। কিন্তু এই বেদনা, এই কষ্টও মধুর। মানুষ এমনকি মধুর কষ্টও কেন ভোগ করতে চায় না কে জানে!

৫.

এত এত সম্পর্ক আমাদের তবু কেউ কেউ কেন এমন নিঃসঙ্গ বোধ করে? কেন কারো কারো মনে হয়-

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা।

তবে কি কোনো সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত আশ্রয় দেয় না মানুষকে?

কোনো কোনো মানুষ হয়তো কারো কাছে আশ্রয় খুঁজে পায়, নিজেকে অনেকখানি মেলেও ধরতে পারে, নিজের দুঃখ-বেদনা-হাহাকার-কষ্ট আর না পাওয়ার যন্ত্রণার কথা, সুখ-আনন্দ-প্রাপ্তি-উচ্ছ্বাসের কথা অবলীলায় অকুণ্ঠে বলে যেতে পারে। এরা উদার ও প্রকাশক্ষম মানুষ, সম্পর্কিত মানুষটিকে সে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে- নিজেকে মেলে ধরতে তাই দ্বিধা করে না।

কিন্তু সমস্যাটা অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়েই, স্বভাবতই যারা প্রকাশ-অক্ষম। এরা নিজেদের প্রায় সমস্ত কথাই গোপন করে রাখে, প্রায় কিছুই প্রকাশ করে না বা করতে পারে না। হয়তো কোনো একজন মানুষকে সব কথা বলে দেবার মতো বিশ্বাসযোগ্য বলেও মনে করেনা বা করতে পারে না, সম্পূর্ণভাবে আস্থাও রাখতে পারে না কারো ওপর। অন্তর্মুখী মানুষরা তাই অন্যের ভালো বন্ধু হয় বটে, কারণ তারা বলে কম, শোনে বেশি, কিন্তু নিজেরা কোনো বন্ধু খুঁজে পায় না। তাদের অধিকাংশ কথা অকথিত রয়ে যায়, প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণায় তারা বিপন্ন ও দগ্ধ হতে থাকে- কোনোকিছুতেই তাদের মুক্তি মেলে না। এদের মতো অসহায় মানুষ আর নেই পৃথিবীতে। সম্পর্ক ব্যাপারটা দ্বিপাক্ষিক- এরা তা বোঝে না, অথবা বুঝলেও স্বভাবের কারণেই নিজেকে মেলে ধরার ব্যাপারে কুণ্ঠিত হয়ে থাকে সবসময়। তাদের এই স্বভাব যতটা না স্বনির্মিত তারচেয়ে বেশি প্রকৃতিপ্রদত্ত- এরা তাই প্রকৃতিগতভাবেই দুঃখী-একা-বিপন্ন।
কিন্তু এই দু-ধরনের মানুষই কিছু কিছু কথা সারাজীবনের জন্য গোপন করে রাখে। কিছু কষ্ট-অপমান-যন্ত্রণা ও বেদনার কথা কাউকেই কোনোদিন বলা হয় না তার। এইরকম অনেক কথাই বুকের গোপন কোটরে জমা রেখে মানুষকে মরে যেতে হয়!

তাহলে কতদূর এগুলো মানুষ? এই এত এত বিপুল সৃষ্টি, আবিষ্কার আর সাফল্য- এত গান, এত কবিতা, এত গল্প-উপন্যাস, এত দর্শন, বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিজয়যাত্রা, মনস্তত্ত্ব নিয়ে এত ভাবনাচিন্তা-তত্ত্ব-তথ্য এবং এই এত এত আরো সবকিছু অথচ মানুষ আজও এমন একটি নির্মাণ করতে শেখেনি- যা আয়নার মতো স্বচ্ছ, যার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে দেখে নেয়া যায়, যার কাছে নিজের সব-সব কথা বলে যাওয়া যায়, অনেক কথা না বলে না বলতে পারার বেদনা নিয়ে চলে যেতে হয় না।

আমার মনে হয়- সম্পর্কই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের জীবনে। অমন একটি সম্পর্ক যে পর্যন্ত মানুষ নির্মাণ না করতে শিখবে মানুষ, ততদিন পর্যন্ত তার মুক্তি নেই।

( সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন